ঢাকা: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকমাস বাকি। এবারই প্রথম প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘পোস্টাল ভোটিং সিস্টেম’ চালু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শুধু প্রবাসীরাই নয়, ভোটের সময় যারা কাজের প্রয়োজনে নিজ এলাকার বাইরে থাকবেন, তাদের জন্যও পোস্টাল ভোটের ব্যবস্থা থাকবে। তবে এই ‘পোস্টাল ভোটিং’ সিস্টেমের মাধ্যমে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কমপক্ষে ২০ দিন আগে ভোট দেবেন প্রবাসীরা।
নির্বাচন কমিশন প্রবাসীদের ভোট প্রদান নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। প্রবাসী ভোটের নিবন্ধনের জন্য এরই মধ্যে একটি অ্যাপের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই অ্যাপটি শিগগিরই উদ্বোধন করতে যাচ্ছে ইসি। তবে অ্যাপের নিবন্ধন প্রক্রিয়া, ভোটিং পদ্ধতি, ব্যালট পেপার পৌঁছানো ও ফেরত আনা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার সামনে। এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ’র সঙ্গে।
এ সময় সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একজন প্রবাসী বিদেশের মাটিতে বসে দেশে নির্বাচনের অন্তত ২০ দিন আগেই ভোট দেবেন। তারা আগে ভোট দিলেও সেগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তার আওতায় ট্রেজারিতে সিলগালা অবস্থায় থাকবে। ভোটের দিন সংশ্লিষ্ট আসনের ভোটগ্রহণ শেষে প্রবাসীদের ভোট গণনা করা হবে।’
ইসির সিনিয়র এই সচিব জানান, এই ভোটের প্রক্রিয়া শুরু হবে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপে নিবন্ধনের মাধ্যমে। গুগল প্লে স্টোর কিংবা অ্যাপল অ্যাপ স্টোর থেকে ডাউনলোড করে অ্যাপটি ইনস্টল করে নিতে হবে। দেশসেরা এক্সপার্টদের সমন্বয়ে অ্যাপটি তৈরি করা হচ্ছে। কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এরপর ট্রায়াল শেষে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপটি।
আখতার আহমেদ বলেন, ‘প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন দু’ভাবে হতে পারে। একটি হতে পারে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে নিবন্ধন করা যাবে। আরেকটি হলো অঞ্চলভিত্তিক। যেমন- এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, সাউথইস্ট এশিয়া, ইউরোপ, নর্থআমেরিকা এভাবে রিজিওন হিসেবে।’
তিনি জানান, যারা প্রবাসে রয়েছেন, তারা এনআইডি নম্বর, বর্তমান ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করবেন। নিবন্ধিত হওয়ার পর প্রবাসী ভোটার কোন ঠিকানায় ব্যালট পেপার পেতে চান, সে ঠিকানা দিতে হবে অ্যাপে। তবে প্রবাসে নিবন্ধন করার পর ভোটের দিন যদি বাংলাদেশে থাকেন; আর যদি বলেন আমি দেশে ভোট দেব, সেটা হবে না। তাই দেশের বাইরে থেকে নিবন্ধন করলে সেখানে থেকেই ভোট দিতে হবে।
যেভাবে নিবন্ধন ও ভোট দিতে হবে
পোস্টাল ভোটিংয়ের একটি নির্দেশিকা ভিডিও টিউটোরিয়াল থাকবে। এতে নিবন্ধনের প্রক্রিয়াও তুলে ধরা হবে। এজন্য মোবাইল অ্যাপে গিয়ে প্রথমে ভাষা নির্বাচন করতে হবে। তার পর ‘রেজিস্ট্রেশন করুন’ বাটনে ক্লিক করে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ভোটার যে দেশ থেকে নিবন্ধন করছেন, প্রথমে সে দেশের নাম বাছাই করতে হবে। পরবর্তী ধাপে ভোটারের মোবাইল নম্বর যাচাইয়ের জন্য ওটিপি পাঠানো হবে। ওই ওটিপি অ্যাপে ব্যবহার করতে হবে। এর পর মোবাইল নম্বর যাচাই শেষে ভোটার তার অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড সেট করবেন।
এর পর মোবাইল নম্বর দিয়ে লগইন করে ফেসিয়াল ভেরিফিকেশন এবং লাইভলাইনস যাচাই করা হবে। এক্ষেত্রে অ্যাপের মাধ্যমে ভোটারের মুখমণ্ডলের ছবি তুলতে হবে। এই প্রক্রিয়া শেষে ভোটারকে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোপোর্টের তথ্য অ্যাপে দিতে হবে। পরবর্তী ধাপে ভোটার যে দেশে অবস্থান করছেন, তার বিস্তারিত ঠিকানা দিতে হবে। এ ঠিকানায় পোস্টাল ব্যালট পেপার পাঠানো হবে।
নির্বাচন কমিশন প্রবাসীদের জন্য ডাক বিভাগের মাধ্যমে পোস্টাল ব্যালট পেপার পাঠাবে। ভোটারের কাছে বহির্গামী খামে (খাম নম্বর-১) ফেরত খাম (খাম নম্বর-২) ও পোস্টাল ব্যালট পেপার সম্বলিত আরেকটি খাম (খাম নম্বর-৩) পাঠানো হবে। ফেরত খামের মধ্যে ভোটারের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তার ঠিকানা থাকবে। পোস্টাল ব্যালট পেপারে শুধু প্রতীক থাকবে; প্রার্থীর নাম থাকবে না। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ভোটারকে প্রবাস থেকে ভোট দিতে হবে।
ভোটার ব্যালট পেপারে প্রতীকের পাশে ফাঁকা ঘরে টিক (√) চিহ্ন কিংবা ক্রস (x) চিহ্ন দিয়ে ভোট দেবেন। এক্ষেত্রে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে স্ব স্ব আসনের বিপরীতে প্রার্থীর নাম ও প্রতীক দেখে নিতে পারবেন। ভোট দেওয়ার পর ব্যালট পেপারটি ফেরত খামে রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। ভোটারের নিকটস্থ ডাকঘরে যথা শিগগির সম্ভব ফেরত খামটি জমা দেবেন। ভোটের দিনের আগেই ভোটারদের ব্যালট পেপার স্ব স্ব রিটার্নিং অফিসারের কাছে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে এ ভোট গণনা হবে না। ফেরত খামের ডাক মাশুল পরিশোধ থাকবে। তাই ভোট দিয়ে ফেরত খামের জন্য প্রবাসী ভোটারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না।
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘পোস্টাল ব্যালটের কার্যকারিতা কতটুকু হবে এইটা একটা প্রশ্ন? কারণ, প্রায় দেড় কোটি রেমিটেন্স যোদ্ধা আছেন প্রবাসে। যে উদ্দেশ্য বা স্পিরিট নিয়ে কাজ শুরু করেছে ইসি, সেইটা এই পদ্ধতিতে খুব বেশি কার্যকরী হবে না বলে মনে করি আমি। সেইসঙ্গে দেশে যারা ভোটের দিনে সরকারি কাজে যুক্ত থাকেন তাদের মাঝেও কতটা সাড়া ফেলবে, সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেননা বিগত নির্বাচনে দেশের মাঝে সর্বোচ্চ ৪০০ ভোট এসেছে পোস্টাল ভোটের মাধ্যমে।’
এই বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমান এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এমন পদ্ধতি বের করতে হবে যেন অনলাইনেই একক্লিকের মাধ্যমে ভোট দেওয়া যায়। সেজন্য যথেষ্ট রকমের সতর্কতা বজায় রেখে, ক্রেডিবিলিটি নিশ্চিত করে একটি সিস্টেম দাঁড় করতে হবে। যদি সত্যিকার অর্থে নির্বাচন কমিশন প্রবাসীদের ভোটে আগ্রহী করতে চায়, তাহলে অনলাইন পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে হবে।
অধ্যাপক রাজ্জাক বলেন, ‘এ কাজে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তবে কমিশনে যারা আছেন, সময় নিয়ে তারা সামনের দিনগুলোতে একক্লিকের মাধ্যমে অনলাইন কীভাবে ভোট দেওয়া যায় সেটা নিয়ে ভাবতে পারেন। এজন্য টেস্ট হিসেবে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনে অল্প অল্প করে এই পদ্ধতি হাতে নিয়ে, ভোটেরদের আস্থা অর্জন করেই পুরোপুরি অনলাইন সিস্টেমে এগিয়ে যেতে হবে।’ এজন্য তাড়াহুড়া না করে, সময় নিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপে কাজ করার তাগিদ দেন এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।