ঢাকা: বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের যেকোনো দেশে বেশি ট্যাক্স দিলে সরকারের কাছ থেকে ভালো সেবা পাওয়া যায় উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমাদের দেশে মানুষ ট্যাক্স দেয়, কিন্তু সেবা পায় না। সেজন্য ট্যাক্সদাতারা তো একটু অভিমান করবেই। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপির হার কমার পেছনে এটিও একটি কারণ।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের বন্ড ও সুকুক বাজার উন্মোচন: রাজস্ব স্থিতি, অবকাঠামো বাস্তবায়ন ও ইসলামি মানি মার্কেট উন্নয়ন’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দেশে সমস্যা হলো অর্থায়নের অভাব। আমরা যেখানে বসে থাকি, সরকারি লোকজন মনে করে সবকিছু দিয়ে দেওয়া যাবে। প্রতিদিন বলে এই দেন, সেই দেন। অর্থের যতটা সামর্থ্য, সেটা আমরা পাচ্ছি না।’
তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স, নন-ট্যাক্স রেভিনিউ আমাদের অনেক লো। আমাদের দেশে প্রাইভেট সেক্টরের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের চাহিদা অনেক বেশি। বলেন বড় বড় প্রজেক্ট করেন। এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থায়ন করতে পারছি না। আমরা বলি, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। তারপর শিক্ষার কথা বলেন। টাকা কোথায়?’
তিনি আরও বলেন, ‘ট্যাক্স কমানোর কথা বলে। ট্যাক্স কমাতে কমাতে এমন অবস্থা, আমরা হয়তো বেতন-ভাতাও পাব না। সবাই বলে ট্যাক্স কমিয়ে দেন। ট্যাক্সই দিতে চাই না। আমরা শিক্ষকদের দোষ দিই, পড়াচ্ছেন না। এই মাইনে দিয়ে কী পড়াবেন? আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ব্রাজিলে ২৬ শতাংশ ট্যাক্স জিডিপি রেশিও। ওরা ট্যাক্স দেয়, সেবা পায়।’
এ সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দেশে ট্যাক্স দেয়, সেবা পায় না। লোকজন তো একটু গোসা করবেই। ট্যাক্স দিলাম, আর সেবা পেলাম না। সেজন্য আমি প্রায়ই এনবিআর সদস্যদের বলি, ভাই একটু সেবা দেন। সেবা ভালো দিলে আমরা ট্যাক্স ফিটাও বেশি দিতে পারি। সেবা দেবেন না, ১০ বার ঘুরাবেন, আপনি ফিও বেশি চাইবেন এটা তো সম্ভব নয়।’
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ অর্লিন্সের অধ্যাপক এম কবীর হাসান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির দেশ হওয়ার পরও এখানে আটটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি রয়েছে। এত বেশি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দু’টি, মালয়েশিয়ায় দু’টি, চীনে তিনটি, কোরিয়ায় তিনটি এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশে মাত্র দু’টি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বেশি সংখ্যক রেটিং এজেন্সি হওয়ায় প্রয়োজনীয় কাজ না থাকায় তারা টিকে থাকার জন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আপস করেছে। এতে তারা ব্যাংকগুলোর গুণমান ও মূল্য উভয় ক্ষেত্রেই যথার্থতা নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছে। বিপরীতে ব্যাংকগুলো মানহীন রেটিং থাকার পরও উচ্চতর রেটিং দেখিয়ে সুবিধা নিয়েছে।’
এই অধ্যাপক আরও জানান, বাংলাদেশে ২০০৪-২০০৫ সালে মাত্র দুটি রেটিং এজেন্সি ক্রেডিট রেটিং নির্ণয়ের কাজ করতো। সেগুলো হলো– ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (সিআরআইএসএল) এবং ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিআরএবি)।
পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে ‘ব্যাসল-২’ চালু করার ক্ষেত্রে আরও কতগুলো ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিকে লাইসেন্স দেওয়ার জন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে আবেদন জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় পরে আরও ছয়টি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অনুমোদন পেয়ে রেটিং নির্ণয়ের কাজ শুরু করে।
অধ্যাপক এম কবির হাসান ব্যাংকিং খাতকে বাঁচাতে এবং বন্ড বাজারের জন্য মান নির্ধারণের পথ সহজ করতে রেটিং এজেন্সিগুলোর সমস্যা দ্রুত সমাধানে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা সমর্থন করার জন্য মানহীন রেটিং এ খাতের জন্য খুবই বিপজ্জনক বলে হুঁশিয়ারি দেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও পুঁজিবাজার উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খোন্দকার রাশেদ মাকসুদ।