চট্টগ্রাম ব্যুরো: আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বিদেশে সম্পদ গড়ার তথ্য মিলেছে তার শিল্পগ্রুপের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার জবানবন্দিতে।
পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলাউদ্দিন মাহমুদের আদালতে জবানবন্দি দেন দু’জন। দুই কর্মকর্তা হলেন- জাবেদের পারিবারিক শিল্পগোষ্ঠী আরামিট গ্রুপের দুই সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) আব্দুল আজিজ ও উৎপল পাল।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাচারের অভিযোগে গত ২৪ জুলাই দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমান চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে-১ একটি মামলা করেন। মামলায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামানসহ ৩১ জনকে আসামি করা হয়। আব্দুল আজিজ ওই মামলার এজাহারভুক্ত এবং উৎপল পাল তদন্তে সম্পৃক্ততা পাওয়া আসামি।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে দুজনকে নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) টিম। এর পর তাদের আদালতের নির্দেশে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দুদকের তথ্যানুযায়ী, এদের মধ্যে আরামিট গ্রুপের এজিএম (ফিন্যান্স) উৎপল পাল সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশের সম্পদ অর্জন ও দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। উৎপল দেশ থেকে দুবাই এবং দুবাই থেকে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে জাবেদের পরিবারের অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার মাস্টারমাইন্ড। অন্যদিকে, আব্দুল আজিজ আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়ামের এজিএম হিসেবে জাবেদের সম্পদ কেনা-বেচা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোকাররম হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসামি আব্দুল আজিজ ও উৎপল পাল উভয়ে জবানবন্দি দিয়ে জাবেদের দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। উৎপল পাল জানিয়েছেন, মন্ত্রী থাকার সময় জাবেদ যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে সম্পদ অর্জন করেন। সেই সম্পদের নথিপত্র বিদেশ থেকে আরামিট গ্রুপের কার্যালয়ে আসতো। সেগুলো উৎপলের টেবিলে জমা হতো। এর পর জাবেদের নির্দেশে তাদের গাড়িচালক ইলিয়াছ সেগুলো নিয়ে যেতেন।’
‘আর আব্দুল আজিজ জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, জাবেদের নির্দেশে তার নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ইউসিবিএল থেকে একাধিকবার লোন নেওয়া হয়। পরে সেই টাকা জাবেদ বিদেশে পাচার করেন। শুধু আব্দুল আজিজ নন, এরকম আরও কয়েকজনের নামে নামসর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে লোন নেওয়া হয়। বাস্তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। শুধুমাত্র ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিদেশে পাচারের জন্যই সেগুলো খোলা হয়েছিল। আর পুরো প্রক্রিয়াটা হয়েছিল জাবেদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়ে।’
এদিকে, রিমান্ডে আজিজ ও উৎপলকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) ভোরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা এলাকার সিকদার বাড়ি থেকে ২৩ বস্তা নথিপত্র জব্দ করা হয়। বাড়িটি জাবেদের স্ত্রী ইউসিবিএল’র সাবেক চেয়ারম্যান রুকমিলা জামানের গাড়িচালক মো. ইলিয়াছের।
সেই নথিপত্র যাচাইবাছাইয়ের পর দুদক জানায়, মোট নয়টি দেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো হলো- আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, দুবাই, সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ প্রয়াত শিল্পপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বড় ছেলে। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। সেখান থেকে বাবু একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাবেদ প্রথমে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হিসেবে পারিবারিক ব্যবসা আরামিট গ্রুপ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড দেখাশোনা করতেন। ব্যবসায়ী সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেন। তার বাবাও একই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
২০১২ সালে আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুর পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ওই আসনে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন। এর পর ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালে দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালে আবারও মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে মন্ত্রিসভায় আর জায়গা হয়নি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে লন্ডনে তার অবস্থানের তথ্য প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুদক তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে। এর পর জাবেদের নিজ মালিকানাধীন ব্যাংক ইউসিবিএল থেকে লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার ও বিভিন্ন দেশে সম্পদ গড়ার একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসতে থাকে।