Wednesday 24 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডিসির হস্তক্ষেপে সিলেটে নিষিদ্ধ
শিলং তীরের ভয়ংকর ফাঁদ, পরিণতি সর্বনাশ

জুলফিকার তাজুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৫

‘শিলং তীর’ অনলাইন জুয়া

সিলেট: একটি খেলা—নাম “শিলং তীর”। বাইরে থেকে নিছক ভাগ্য পরীক্ষার খেলা মনে হলেও বাস্তবে এটি রূপ নিয়েছে ভয়ংকর এক সামাজিক ব্যাধিতে। প্রতিদিন হাজারো তরুণ–তরুণী, গৃহবধূ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পর্যন্ত এই খেলায় আসক্ত হয়ে হারাচ্ছে অর্থ, ভবিষ্যৎ, এমনকি পরিবার। সিলেট জেলা প্রশাসন অবশেষে এই “শিলং তীর” জুয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

পরিবার ধ্বংসের খেলায় পরিণত তীর

অনেক পরিবারে দেখা গেছে—একজন স্বামী ‘তীর খেলা’তে আসক্ত হয়ে দিনের পর দিন বেতন বা ব্যবসার আয় ঢালছেন জুয়ায়। কিছুদিন পর ঋণের পাহাড়, মানসিক অবসাদ এবং সংসারে কলহ শুরু হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, “প্রথমে মজার ছলে হাজার টাকায় শুরু করছিলাম, তারপর লাখের ওপরে উঠল। একদিন সব হারিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি—ঋণের চাপে স্ত্রী চলে গেছে, দোকানদার তালা লাগিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গোপনে অনেকেই পরিবারের গয়না বিক্রি করছেন, ব্যাংক ঋণ কিংবা মোবাইল অ্যাপ লোন নিয়ে জুয়ায় অর্থ ঢালছেন—ধারণা করছেন এবার নিশ্চয়ই জিতবেন। কিন্তু পরিণতি একটাই: সর্বনাশ।

 

জুয়ার যুক্ত হওয়ার ফি এর জমা রশিদ

জুয়ার যুক্ত হওয়ার ফি এর জমা রশিদ

 

তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে ঝুঁকিতে

বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের একাংশ ভয়ংকরভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে এই অনলাইন বেটিং–এ। অনেকে গেমের স্কিন বেটিং বা ভার্চুয়াল কয়েন বাজি থেকে শুরু করে আসছে এই খেলার দুনিয়ায়। একটি এনজিও রিপোর্ট বলছে, ঢাকাসহ সিলেট, রাজশাহী, কুমিল্লা, বরিশালে প্রতি ১০ জন তরুণের মধ্যে অন্তত ৩ জন কোনো না কোনো জুয়ার সঙ্গে যুক্ত। অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে—চুরি, প্রতারণা, এমনকি ব্ল্যাকমেইলিং।

কোটি কোটি টাকা পাচার

সরকারি সূত্র জানায়, প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (বিকাশ, নগদ, রকেট) এর মাধ্যমে এই জুয়ার প্ল্যাটফর্মে লেনদেন হচ্ছে। যেহেতু অধিকাংশ প্ল্যাটফর্ম বিদেশে হোস্টেড, তাই অর্থ পাচারও নিয়মিত হচ্ছে। এতে শুধু পরিবার নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্রও—রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “ভিপিএন, ফেক অ্যাপ, ফেসবুক–ইউটিউব লাইভ ব্যবহার করে প্রচার চালানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকেও কনটেন্ট রিমুভে চাপ দিতে হবে।”

প্রশাসনের অবস্থান

২১ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলা প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে তীর খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারি আদেশে বলা হয়—“তীর খেলাসহ যে কোনো অনলাইন জুয়া জেলা জুড়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পাবলিক গ্যাম্বলিং আইন

বাংলাদেশে পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ অনুযায়ী জুয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। পাশাপাশি নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৫ অনুসারে অনলাইন বেটিং, প্রচারণা ও লেনদেনের দায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

শিলং তীরের উৎপত্তি ও বিস্তার

তীর খেলার সূত্রপাত ১৯৯০-এর দশকে ভারতের শিলং ও গৌহাটিতে। সীমান্তবর্তী সিলেটে কয়েকজন প্রথমে হুন্ডির মাধ্যমে এতে যুক্ত হন। এরপর ধীরে ধীরে এর বিস্তার ঘটে সিলেটসহ সারা দেশে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এজেন্ট জানান, ‘তিন স্তরের এজেন্টদের মাধ্যমে অনলাইনে তীরশিলং খেলাটি হয়। দিনে দু’বার ড্র হয়। একবার বিকাল সাড়ে ৪টায়, দ্বিতীয় ড্র হয় সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে। এতে ভারতের শিলং থেকে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রতিদিনের শুরুতেই অনেকগুলো কমন নম্বর দেওয়া হয়। এই নম্বরগুলোকে কেন্দ্র করেই সারাদিন ছুটে বেড়ান তীরশিলং খেলতে আগ্রহীরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্দিষ্ট এজেন্টরা মুহুরীর (সংগ্রাহক) মাধ্যমে গ্রাহক সংগ্রহ করে। মুহুরীর থ্রো ছাড়া কোনও ব্যক্তিই সরাসরি তীরশিলংয়ে অংশ নিতে পারে না। এক্ষেত্রে যেটি দাঁড়ায়, প্রথমে এজেন্ট, এরপর মুহুরী, এরপর গ্রাহক।’ এই তিন স্তরের মধ্যে প্রথম গ্রুপটি ভারতের শিলং থেকে অনলাইনে জুয়াটি ছাড়ে। এরপর একটি অংশ এই জুয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে সিলেটে। এদের মাধ্যমে জুয়া থেকে আয় করা টাকা সংগ্রহ করা হয়।

সারাবাংলা/এসএস

পরিণতি ফাঁদ ভয়ংকর শিলং তীর সর্বনাশ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর