নোয়াখালী: গত বছরের বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই চলতি বছরে মে মাস থেকে টানা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা জলাবদ্ধতায় নোয়াখালীর ৯টি উপজেলার সড়ক ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে’। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রায় ৪০০ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দীর্ঘ জলাবদ্ধতা ও সড়কগুলোর বেহাল দশার ফলে সাধারণ যাত্রী ও পথচারীরা অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের এই বৃষ্টির কারণে সড়কে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় গর্তের, আবার কোথাও সড়কের পাশ ভেঙে মিশে গেছে পাশের জলাশয় বা খেতের সঙ্গে। বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর অনেকাংশ এখনও কাদা-মাটি ও পানিতে একাকার হয়ে আছে।
নোয়াখালীর ৯টি উপজেলার এলজিইডির বেশিরভাগ সড়কেই এই করুণ চিত্র দেখা যায়। যার ফলে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে মালবাহী ট্রাক, পিকআপ, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাইক্রোবাসসহ ছোট-বড় নানা যানবাহন। সড়কে অসংখ্য গর্ত ও খানা-খন্দ থাকায় প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ছোট যানবাহনগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়ায় গর্তে পানি জমে থাকার কারণে চালকরা সড়কের অবস্থা অনুমান করতে না পারায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব সড়ক মেরামত ও সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে এলাকা ঘুরে ও এলজিইডির তথ্যমতে, এই দীর্ঘ জলাবদ্ধতার শিকার হওয়া উল্লেখযোগ্য সড়কগুলো হলো— সদর উপজেলার উদয় সাধুরহাট-করমুল্যা সড়ক, ওদারহাট-সফিগঞ্জ বাজার সড়ক, ও বাংলা বাজার-শান্তিরহাট সড়ক।
এছাড়া, সুবর্ণচর উপজেলার আট কপালিয়া-হালিম বাজার-বগার বাজার সড়ক, জনতা বাজার-কেরামতপুর বাজার সড়ক, পরিষ্কার বাজার-পাঙ্খার বাজার সড়ক, সমিতির বাজার-কাঞ্চন বাজার সড়ক, খাসেরহাট-সমিরহাট সড়ক, জাহাজমারা-ভূইয়ারহাট সড়ক ও দক্ষিণ ওয়াপদা-আল আমিন বাজার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একই অবস্থা সোনাইমুড়ী উপজেলার ধন্যপুর-চাঁদপুর সড়ক, আমিশাপাড়া কলেজ-স্যামেরখিল সড়ক, নবগ্রাম রুস্তম কোম্পানী মসজিদ-দূর্গা দৌলতপুর আবদুল জলিল পাটোয়ারী ব্রিজ সড়ক ও ধন্যপুর আবু ডাক্তার সড়কের।
ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের তালিকায় আরও রয়েছে— কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বামনি কলেজ-বাঞ্চারাম বাজার সড়ক, বসুরহাট বাংলা বাজার-এসপি আবু সুফিয়ান বাড়ি সড়ক, ও নতুন বাজার-বামনি সড়ক।
এছাড়াও কবিরহাট উপজেলার কবিরহাট-চাপরাশিরহাট-শাহজিরহাট সড়ক, রহমত নগর-নলুয়া ভূইয়ারহাট সড়ক, এবং চাপরাশিরহাট- গুল্লাখালি-মৌলভী বাজার সড়কও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের তালিকায় আরও রয়েছে হাতিয়া উপজেলার ডিসি সড়ক-ওয়াপদা সড়ক, কাজীর টেক-মহি উদ্দিন বাজার-দিদার বাজার-টিনের মসজিদ সড়ক।
সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া-তেমুহনী সড়ক, বসন্তপুর-বিরাহিমপুর বাজার সড়ক, কুতুবের হাট-চন্দেরহাট-সেবারহাট সড়ক, সিলোনিয়া বাজার-তরিক উল্যা বীর বিক্রম-জমিদারহাট সড়ক এবং চাটখিল উপজেলার নোয়াখলা-রাহিমগঞ্জ সড়ক, বাজার রোড-সোনাচাকা সড়ক, মানিকপুর-ছান্দিয়া পাড়া-সপ্তগাও সড়ক।
তবে, এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি সড়ক- সদর উপজেলার উদয় সাধুরহাট-করমুল্যা সড়কের ২১ কিলোমিটার এবং কবিরহাট উপজেলার চাপরাশিরহাট-গুল্লাখালি-মৌলভী বাজার সড়কের প্রায় ১০ কিলোমিটার।
কবিরহাট উপজেলার চাপরাশিরহাট ইউয়িনের নতুন শাহজিরহাট এলাকার বাসিন্দা মহি উদ্দিন লিটন বলেন, ‘গত বছরের বন্যায় শাহজিরহাট থেকে চাপরাশিরহাট যাওয়ার সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মাঝে এক বছরে তেমন কোনো কাজ না হওয়ায় এ বছর আবার পানি উঠে সড়কটির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। এখন সড়কের বেশিরভাগ অংশেই বড় বড় গর্ত। এই সড়কটি দিয়ে কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন অনেক গাড়ি চলাচল করে। বর্তমানে সড়কটি চলাচলের একেবারেই অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।’
সদর উপজেলার ওদারহাট এলাকার বাসিন্দা ফারুক বলেন, ‘মে মাস থেকে ওদারহাট-সফিগঞ্জ বাজার সড়কের বিভিন্ন অংশ পানিতে ডুবে ছিল। এখন পানি নামার পর ছোট-বড় অনেক গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাতায়তের কারণে কোমর ব্যথা’সহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই সড়কটি দিয়ে মাইজদীতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে, তাই দ্রুত এটির মেরামত করা দরকার।’
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলায় তাদের প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার পাকা সড়ক এবং কিছু কাঁচা সড়ক রয়েছে। এবারের জলাবদ্ধতায় এসবের মধ্য থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার সড়ক প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সদর, কবিরহাট, বেগমগঞ্জ, হাতিয়া, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
এলজিইডি আরও জানায়, জলাবদ্ধ অবস্থায় এসব সড়ক দিয়ে ছোট-বড় সবধরনের যানবাহন চলাচল করায় নিমজ্জিত সড়কগুলোর সার্ফেস, পেভমেন্ট, সোল্ডার, ঢাল, ফাউন্ডেশন, স্ট্রাকচারাল, সাবগ্রেড ও সাব-বেজসহ বিভিন্ন স্তর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে সড়কে ছোট-বড় অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে এবং কোথাও কোথাও সড়কের পাশ ভেঙে পার্শ্ববর্তী খেত ও জলাশয়ে গিয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডি নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মাহফুজুল হোসাইন বলেন, ‘জলাবদ্ধতা স্থায়ী হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়েছে। এসব সড়কের উপজেলা ভিত্তিক তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি এবং বরাদ্দ চেয়েছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি সড়কের কাজ শুরু করা হবে।’