ঢাকা: ‘নিয়মিত কমিউনিটি ক্লিনিকে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ১৫ মাস ধরে আমরা বেতন পাচ্ছি না। আমরা এতটাই অসহায় জীবনযাপন করছি যে, বাবাকে ওষুধ কিনে দিতে পারছি না। ওষুধের অভাবে বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তখন কীভাবে নিজেকে বুঝাব। স্বামী-সন্তান নিয়ে আমরা খুবই অমানবিক জীবনযাপন করছি। কারও কারও বিবাহ বিচ্ছেদও হয়ে যাছে।’ চোখের পানি মুছতে মুছতে এভাবেই সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) ইয়াসমিন আরা।
তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের অবস্থা নিয়ে বলার মতো ভাষা নাই। অফিসে যাওয়ার সময় পরিবারে কথা শুনতে হয়- কিসের চাকরি করে যে বেতনই পায় না। সংসারে টাকা দিতে না পারায়, বউয়ের চাহিদা মেটাতে না পারায় কারও কারও বিবাহ বিচ্ছেদও হয়ে গেছে। আমরা এর একটা সমাধান চাই।’
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস যখন ইউএনজিএতে বাংলাদেশের প্রাথমিক চিকিৎসার পরিকল্পনা নিয়ে উচ্চ লেভেলের আলোচনায় বসেছেন, ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশের একমাত্র কমিউনিটিভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ৬৩৪ জন সৈনিক রুজি রোজগারের জন্য পথে নেমেছেন।
মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চে প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষা ও ভাইবার মাধ্যমে ১৩ হাজার ৯২৩ জন সিএইচসিপি নিয়োগ দেয় কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট। একটা সময় পর ১৩ হাজার ৯২৩ জনের মধ্য থেকে ১৩ হাজার ২৮৯ জনের চাকরি স্থায়ী করা হয়। ওই সময় কোনো কারণ ছাড়াই ৬৩৪ জনকে অস্থায়ী রাখা হয়। ফলে ২০২৪ সালের পর থেকে বেতন বন্ধ হয়ে যায় ৬৩৪ জন সিএইচসিপির। অথচ, তারা এখনও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে।
গোপালগঞ্জের মকসুদপুরে কর্মরত সিএইচসিপি সাকির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে আমরা এখনও কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই থেকে আমাদের বেতন বন্ধ। এর কারণও অজানা। আমরা মন্ত্রণালয়সহ সব যায়গায় গিয়েছি, তারা আইনিভাবে দেখাতে পারেনি যে, আসলে সমস্যা কোথায়। আমরা প্রিলি, লিখিত পরীক্ষা ও ভাইবার মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছি। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকার পরও ১৩ হাজার ৯২৩ জনের মধ্য থেকে ১৩ হাজার ২৮৯ জনকে স্থায়ী করা হয়েছে। আর কোনো কারণ ছাড়াই ৬৩৪ জনকে অস্থায়ী রাখা হয়েছে। পাওনা না পেলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সব কার্যক্রম স্থবির করে দিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।’
মানবেতর জীবনযাপন করছেন গাইবান্ধার সুন্দরপুরের সিএইচসিপি ওবায়দুল ইসলাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা খুবই অসহায় জীবনযাপন করছি। রোজার ঈদের আগে আমাদের অসহায়ত্বের কথা জানালে স্যাররা আশ্বস্থ করেছিলেন। ঈদের পর আমরা তিনদিনের আন্দোলন করি। তখনও আশ্বাস নিয়ে ফিরে গেলাম। এর পর আরও কয়েকবার আমরা আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছি। কিন্তু আমাদের পাওনা আদায় হচ্ছে না। ১৫ মাস ধরে আমাদের বেতন নাই, দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে এখন আর বাকি নাই। এখন আমরা জেলাগুলো থেকে একজন করে আসছি। এর পর দাবি কার্যকর না হলে প্রয়োজনে ৬৩৪ জন একসঙ্গে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেব।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক অতিরিক্ত সচিব এ কে এম নূরুন্নবী কবিরের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে এই ৬৩৪ জন সিএইচসিপ‘র। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে আটকে থাকে তাদের বেতন। নূরুন্নবী কবির তার সময়ে কী কারণে ৬৩৪ জন সিএইচসিপিকে স্থায়ী করেননি তার উত্তর নেই মন্ত্রণালয়ের কাছেও। ফলে ১৫ মাস ধরে বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই সিএইচসিপিরা।
এদিকে, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইডার (সিএইচসিপি) প্রকল্পের চাকরি রাজস্বখাতে স্থায়ীকরণে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচিবকে তিন কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। আর এই সংক্রান্ত সংবাদ গণমাধ্যমে উঠে এলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট থেকে গত ২১ সেপ্টেম্বর বিষয়টি তদন্তের আদেশ দেয়। এজন্য সিএইচসিপিদের কেন্দ্রীয় কমিটি স্থগিত ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো কারণ ছাড়াই ৬৩৪ জন সিএইচসিপি’র প্রতি অবহেলা করা হয়েছে। ১৫ মাসের বেতন তাদের প্রাপ্য। এটা তাদের অধিকার। এর সম্পূর্ণ দায়ভার আগের কর্মকর্তার। শুনেছি, বেতন না পেয়ে ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন তারা। তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। আমি বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। চেষ্টা করছি সমস্যা সমাধানের। আশা করছি, কয়েকদিনের ভেতর তাদের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিতে পারব।’