পঞ্চগড়: টানা কয়েক দিন ধরে দিনের বেলায় কাঠফাটা রোদে পঞ্চগড়ের আকাশ একেবারেই ভিন্ন। ভোর থেকেই শান্ত-স্বচ্ছ নীল আকাশ। উত্তরে হালকা লালচে মেঘ ভেদ করে উঁকি দিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্লভ দৃশ্য দেখতে পেয়ে অনেকেই ছবি তুলছেন, শেয়ার করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। শরতের এ সময়টাতে আকাশ পরিষ্কার থাকলেই পঞ্চগড় জেলা শহরসহ তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে দেখা মেলে হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার।
গত ২ সেপ্টেম্বরেও উত্তরের এই জনপদে দেখা মিলেছিলো কাঞ্চনজঙ্ঘার। সেদিনের ছবি দেখে এরপর কয়েক দিন পঞ্চগড়ে এসে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা না মেলায় আশাহত হয়ে ফিরেছিলেন অনেক পর্যটক।
অবশেষে শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ভোর থেকে স্পষ্ট হয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার দুর্লভ দৃশ্য। দুপুর পর্যন্ত সূর্যের আলোর তারতম্যে রং বদলেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার। এই দৃশ্যের দেখা মিলছে পঞ্চগড় শহরসহ তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে পঞ্চগড়ের সমতল মাঠজুরে সবুজের চাদর বিছানো। এমন শরতের দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘার নৈশর্গিক দৃশ্য স্থানীয়সহ আগত পর্যটকদের বিমোহিত করেছে।

মেঘের কোলে উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই উত্তরের এই জেলার অধিবাসীরা সুদীর্ঘকাল ধরে উপভোগ করে আসছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। শরৎ, হেমন্ত আর শীতকালেই দেখা মেলে এই মহাশুভ্র নায়কের। কখনো কখনো বছরের অন্যান্য সময়েও আকাশের বুক চিরে উঁকি দেয়। ভোর থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে মেলে ধরে এই শৃংগ। হিমালয়ের স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক শক্তিমান প্রতিভূর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ লুকিয়ে পড়ে মেঘের আড়ালে। আকাশ আর স্থলের দিগন্ত বিস্তৃত ক্যানভাসে যেন আঁকা ছবি। বাতাশে উড়তে উড়তে মেঘ সরে গেলে আবার জেগে ওঠে। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। আবার হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাবার সময় মনে হয় কেউ যেন আস্তে আস্তে মুছে দেয় প্রকৃতির আঁকা সেই ছবি। এ সময় প্রকৃতি আর কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রেমিদের সাথে চলে লুকোচুরি খেলা।
পর্যটকেরা মাথা উঁচু করে ভরা চোখ খুলে তাকিয়ে থাকে দুর বহুদুরে। কখন দেখা মিলবে রহস্যময় এই পাহাড়ের? অপেক্ষা ছাড়া কোনো উপায় থাকেনা তখন। পঞ্চগড়ে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকেরা পঞ্চগড় জেলা শহরসংলগ্ন করতোয়া সেতু থেকে উপভোগ করছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য।
পঞ্চগড় শহর থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে অনেককেই গাড়ি থামিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুলছেন। কেউ কেউ যাচ্ছেন মহানন্দা নদীর তীরে তেঁতুলিয়ার ডাকবাংলোতে।
পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের পাশে মোটরসাইকেল থামিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুলছিলেন যুবক ও তার স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সন্তানসহ পঞ্চগড় শহর থেকে তেঁতুলিয়ার দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ডান দিকের আকাশে চোখে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য। না থেমে পারলাম না। এ জন্য থেমে কয়েকটা ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। দৃশ্যটা অনেক ভালো লাগছে।’
ভজনপুর করোতোয়া ব্রিজের উপরে গাইবান্ধা থেকে আসা আবু দাউদ হোসেন আদম নামে এক পর্যটক বলেন, ‘আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য গাইবান্ধা থেকে তেতুলিয়ার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। রাস্তা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেয়ে বাইক থামিয়ে ছবি ভিডিও করলাম। খুবই ভালো লাগছে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেয়ে।
স্কুল শিক্ষক জয়নাল আবেদীন ঢাকা থেকে এসেছেন তার স্ত্রীকে নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেয়ে খুবই আনন্দের সঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মাঠে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবো এটা কখনো ভাবিনি। আমি প্রতিবছর আমার স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন জেলায় সফর করে এবার আমি পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া এসেছি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য এবং দেখতে পেয়েছি আমি খুবই আনন্দিত।
হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজংঘা। ১৮৫২ সালের আগে পৃথিবীতে কাঞ্চনজংঘাকে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বলেই ধারণা করা হতো। বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া হিসেবে পৃথিবীতে স্থান করে নিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘা উচ্চতা ৮ হাজার মিটার বা ২৬ হাজার ফুট। এই পর্বত চূড়ার মোহনীয় সৌন্দর্য্য দেখতে হাজার হাজার পর্যটক ভারত-নেপাল ভ্রমণ করেন। পঞ্চগড়ে খালি চোখেই দেখা যায় এই পর্বত শৃঙ্গের অপরুপ সৌন্দর্য্য। কাঞ্চনজঙ্ঘার এই মনোমুগ্ধকর রূপ দেখতে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ভীর জমাচ্ছেন পর্যটকেরা। কিন্তু বছর জুড়ে তেঁতুলিয়ায় পর্যটকের ভীর লেগে থাকলেও এখনো পর্যটন কেন্দ্রীক উন্নয়ন ঘটেনি। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ। তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব ১৬৫ কিলোমিটার।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, গত দুই দিন ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের তেঁতুলিয়া থেকে দেখা যায়। আর এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। যেহেতু একদিকে তেঁতুলিয়া পর্যটন এলাকা অন্যদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার মৌসুম। তাই পর্যটকদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব বিষয়ে আমরা নজর রেখেছি। তারা যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে নজর রাখছি। আবাসিক হোটেল থেকে শুরু পরিবহনের লোকজনের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে, যাতে পর্যটকদের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তারা দেখেন। আর থানা পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন মিলে আমরা তৎপর রয়েছি। পর্যটকরা কোনো সমস্যায় পড়লে আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।