সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরাকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এখানে রয়েছে পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। কারণ এই জেলাটিতে স্থলপথে রয়েছে সুন্দরবন ভ্রমণের বড় সুযোগ, ঐতিহাসিক স্থান যশোরেশ্বরী কালীমন্দির ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কপোতাক্ষ নদ, আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম, কলাগাছিয়া ও কচিখালীসহ সুন্দরবনের অংশ, বিশাল বড় মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত এবং রুপসী ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। তবে, সরকারি উদ্যোগ ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে এই সম্ভাবনাগুলো পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
একপাশে সড়ক পথ, অন্যপাশে গভীর সুন্দরবন মাঝখানে প্রবহমান নদী আর অন্য পাশে ভারত সীমান্ত। তাই আপনিও আসতে পারেন, সাতক্ষীরার সড়কপথে বাঘ মামার দেখা পেতে। তবে, ভাগ্যে থাকলে হয়তো দেখা হয়েও যেতে পারে। সুন্দরবন দেখার সুবিধার জন্য এ সড়ক পথই যথেষ্ঠ। তাই তো বলা হয় ‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন’।
সাতক্ষীরা শহর পেরিয়ে যতই দূরে যেতে থাকবেন বঙ্গপোসাগরের কোল ঘেঁষা সুন্দরবনের সীমানায়, ততই ভাবতে ভাবতে ভেসে যাবেন সুন্দর সত্যের কাছাকাছি।
মানচিত্রের সবুজ যে দেশের প্রাণ, সে দেশের সবুজ কত সুন্দর, মহোময় আর প্রাণবন্ত তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন? দেখেছেন সবুজ ছায়াময় গ্রাম আর বন-বনানীর দিকে একবার তাকিয়ে? উপভোগ করেছেন কি এর মনোলোভা সৌন্দর্য? হয়তো কবির মতো বলবেন ‘সময় কোথা সময় নষ্ট করবার’।
প্রধান আকর্ষণসমূহ:
কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম পার্ক
কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রটির একদিকে লোকালয় ও আরেক পাশে সুন্দরবন, আর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে খোলপেটুয়া নদী। বন পেরিয়ে নদী পথে খাল পার হয়ে কলাগাছিয়া যেতে হয়। লোকালয় পার হয়ে সুন্দরবনের পশ্চিম বনের ভেতর দিয়ে কলাগাছিয়া যাওয়ার সময় দুই ধারের সারি সারি বন মুগ্ধ করে।
ঘাটে ট্রলার ভিড়লেই অসংখ্য বানরের দেখা মিলে। মূল অংশে ঢোকার পথে আছে লোহার তৈরি একটি ব্রিজ। এই ব্রিজ পার হলে একটি রেস্ট হাউজ ও কাঠের তৈরি আরেকটি ব্রিজ নজরে আসে। কাঠের সেতুর দুই পাশে আছে খলিশা, হরকোচা ও বাইন গাছের সারি। আর বনের ভেতরে আছে বানর ও হরিণের দল। ওয়াকওয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে পাঁচতলা ওয়াচ টাওয়ার থেকে পাখির চোখে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এখানে বনের ভেতরের শিব মন্দিরে বনবিবির পূজা করা হয়। অনেকের বিশ্বাস, মন্দিরে দর্শন দিয়ে বনের ভেতরে গেলে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
মান্দারবাড়ী সমুদ্র সৈকত
হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর তীরের এক পাশে সুন্দরবন এবং অন্য পাশে মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত এর অপূর্ব প্রকৃতি যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত অজানা একটি স্থান। সাতক্ষীরা জেলার বুড়িগোয়ালিনীর নীলডুমুর নৌঘাট থেকে এই সৈকতের দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। সাতক্ষীরা থেকে নীলডুমুর পর্যন্ত গাড়ীতে এসে বাকি পথ ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা স্পীড বোটে করে যেতে হয়। সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীগুলোই হচ্ছে ৭৫ কিলোমিটার যাত্রা পথের একমাত্র উৎস। তাই প্রায় আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মান্দারবাড়ীয়া সমুদ্র সৈকত শুধুমাত্র বিশেষ ভ্রমণকারীদের জন্য উপযুক্ত যারা কষ্ট স্বীকার করে বঙ্গোপসাগরের মায়াবী জলরাশির অবিশ্রান্ত গর্জন শুনতে রাজি আছেন।
নীলডুমুর ঘাট থেকে খোলপেটুয়া-কপোতাক্ষ নদের মোহনা দিয়ে অতিক্রম করে মান্দারবাড়িয়ায় যেতে কলাগাছিয়া, আড়পাঙ্গাশিয়া, মালঞ্চ নদী বেয়ে যেতে হয়। যাত্রাপথে নদীর উভয়পাশে চিরসবুজ সুন্দরবনকে মোহিত করবে। সঙ্গে দেখা মিলবে হরিণসহ নানা প্রজাতির প্রাণীর চলাচল এবং পানকৌড়ি, বালিহাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। এ ছাড়া, নির্জন এই মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতের বুকে হরিণ কিংবা বাঘের পায়ের ছাপ নিঃসন্দেহে ভ্রমণের উত্তেজনা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে।
যশোরেশ্বরী কালী মন্দির
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে অবস্থিত যশোরেশ্বরী কালী মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান। যশোরেশ্বরী শব্দের অর্থ যশোরের দেবী। সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞের পর সতী মাতা দেহ ত্যাগের পর মহাদেব মৃত দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। বিষ্ণু দেব তাঁর সুদর্শন চক্র কতৃক সতীর দেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহ খণ্ডগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। সতী মাতার দেহখণ্ড যেসব স্থানে পতিত হয়েছে সেসব স্থানকে শক্তিপীঠ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যশোরেশ্বরী কালী মন্দির তেমনি একটি শক্তিপীঠ।
ধারণা করা হয়, আনারি নামের এক ব্রাহ্মণ যশোরেশ্বরী কালী মন্দির এবং শক্তিপীঠের ১০০টি দরজা নির্মাণ করেন। যদিও মন্দিরের নির্মাণকাল সম্পর্কে নিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় যায়নি। পরবর্তীতে লক্ষ্মণ সেন ও মহারাজা প্রতাপাদিত্য যশোরেশ্বরী কালী মন্দির সংস্কার করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লক্ষ্মণ সেন মন্দির সংস্কারের পাশাপাশি মূল মন্দিরের কাছে নাটমন্দির নামে একটি বৃহৎ মঞ্চমণ্ডপ নির্মাণ করেন আর মহারাজা প্রতাপাদিত্য তৈরি করেন কালী মন্দির।
নেই রাস্তাঘাট, নেই ভালো মানের হোটেল মোটেল:
নেই ভালো মানের হোটেল। সুন্দরবনে থাকার জন্য নেই কড়া নিরাপত্তা। গড়ে উঠেনি কোন কটেজ বা রেস্টুরেন্টে। ফলে মুখ ফিরায় নিচ্ছেন পর্যটকরা। সাতক্ষীরা সুন্দরবনে থাকা অপার সম্ভাবনা থাকলে ও মুখ থুবড়ে পড়ছে দিন দিন। রাস্তাঘাট খারাপ ও আধুনিক মানের হোটেল-মোটেলের অভাব থাকায় পর্যটকের আনাগোনা কমেছে। পাশাপাশি সুন্দরবন ভ্রমণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার বেহাল দশা এবং উপযুক্ত রাত্রিযাপনের সুবিধার ঘাটতি পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করছে।
সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত বিলাল হোসেন জানান, সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা, সুন্দরবনের প্রবেশ মূল্য বৃদ্ধি এবং রাত্রিকালিন অবস্থানের পাশ না দেওয়ার কারণে পর্যটক দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে পর্যটনের উপর নির্ভরশীল উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন-জীবীকায়ও ভাটা পড়েছে। যদিও বন বিভাগ বলছে, অনলাইনে সুন্দরবনে প্রবেশের ফি প্রদান করে রিসিট জমা দিলে সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকেই রাত্রিকালীন অবস্থানের পাশ দেওয়া সম্ভব।
শ্যামনগর এলাকার বাসিন্দা আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ সুন্দরবনের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। তারা পর্যটন খাতেই বেশি আয় করে থাকেন। কিন্তু রাস্তাঘাট সংস্কারের অভাব ও টুরিস্ট বোর্ডের ভাড়া বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের এই অঞ্চলে পর্যটক কমে গেছে। তবে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হলে আগে সাতক্ষীরা থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত সড়কটি সংস্কার করা খুবই জরুরি। সুন্দরবনে ২-৩ দিন বা রাত্রিকালীন অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে রেঞ্জ অফিসের সে ক্ষমতা না থাকায় পর্যটকদের এ অঞ্চলে আসার আগ্রহ অনেক কমে গেছে। মূলত রাত্রিকালীন পাশ আনতে খুলনায় যেতে হয়, এটা পর্যটকদের কাছে একটা বিড়ম্বনা। রাত্রিকালীন পাশ পারমিট চালু হলে এই অঞ্চলে পর্যটক অনেক বাড়বে।’
সরকারি উদ্যোগের অভাব:
মানবধিকারকর্মী মাধবচন্দ্র দত্ত বলেন, “বাংলাদেশের একমাত্র জেলা সাতক্ষীরা যেখান থেকে সড়কপথে সুন্দরবন উপভোগ করা সম্ভব। কিন্তু সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জের প্রধান সড়কটির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ও জরাজীর্ণ। বর্তমানে ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় আসতে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগে। আর সাতক্ষীরা থেকে মুন্সীগঞ্জ আসতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। যেমন সড়কের অবস্থা, তেমনি এ সড়কের পরিবহণ ব্যবস্থা। দ্রুত সড়কটি সংস্কার করে চার লেনে প্রশস্ত করা হলে এবং সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে সরাসরি পর্যটকবাহী বাস চলাচলের উদ্যোগ নিলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে পারে।
সাতক্ষীরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রচারণার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পকে আরও বিকশিত করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) ফজলুল হক জানান, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গেলে অবশ্যই সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কের উন্নয়ন করতে হবে আর সুন্দরবনের প্রবেশ ফি বাড়ানো কমানোর বিষয়টি সরকারের। তবে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে রাত্রিকালীন পাশের জন্য অনলাইনে টাকা জমা দেওয়া যাচ্ছে। পেমেন্ট স্লিপ দেখালেই পাশ দেওয়া যাবে।