চট্টগ্রাম ব্যুরো: ভোরের আলো ফুটেছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কালজয়ী সুরে।
‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে
বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর,
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত
জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।’
সত্যিই আজ দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে মর্ত্যলোকে এসেছে মা দুর্গার আগমন বার্তা। মর্ত্যের ভক্তদের কাছে আজ থেকে দুর্গা পূজিত হবেন সাড়ম্বরে। আজ মহাষষ্ঠীতে বিল্বতলায় চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীর পূজা এবং শারদ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হচ্ছে আজ (রোববার)।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) মহা সাড়ম্বরে ষোড়শ উপচারে সারাদেশে মণ্ডপে মণ্ডপে দেবীর অধিষ্ঠান হয়েছে। এরপর আজ (রোববার) সকাল থেকে ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজার মধ্য দিয়ে মূল আচারের শুরু হয়েছে।
সন্ধ্যায় বেলতলায় দুর্গাদেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস হবে। তখন দেবীকে আসার জন্য প্রার্থনা করা হবে। ভক্তদের বিশ্বাস, প্রার্থনার পরিপ্রেক্ষিতে দেবী ঘটে (পাত্রবিশেষ) এসে অবস্থান নেবেন। পরে সেই ঘট, বেলপাতা, ডালসহ নবপত্রিকা মূল মন্দিরে স্থাপন করা হবে।
এর মধ্য দিয়েই মূলত শুরু হলো বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গাপূজার।
তন্ত্রধারক পুতুল দাশগুপ্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেবীপতি মহাশক্তি মহাদেবের প্রিয় বিল্ববৃক্ষ তলেই দেবীর আবাহন হয়। এর মধ্য দিয়ে সংকল্প করা হয়, দশমী পর্বন্ত যথাবিধ উপায়ে আমরা ভক্তরা মায়ের পূজা করবো। দুর্গাপূজার মূল যে আচার সেটা শুরু হয় মহাষষ্ঠীতে আবাহনের মধ্য দিয়ে।’
আশ্বিনের শুক্লপক্ষের অমাবস্যার দিনে গত ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। আর দেবীপক্ষের সমাপ্তি হবে পঞ্চদশ দিনে কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজার মধ্যে দিয়ে। এর মাঝে ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠীতে বোধন। আর দশম দিন, অর্থাৎ দশমীতে বিসর্জন। দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা এই পাঁচদিনই চলে।
তবে বাঙালি সমাজে বেশি প্রচার পাওয়া আশ্বিনের এই দেবীবন্দনা মূল দুর্গাপূজা নয়। এটি ‘অকাল বোধন’ নামে উল্লেখ আছে শাস্ত্রে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মূল দুর্গাপূজা হয় বসন্তকালে, যেটি বাসন্তী পূজা নামে অভিহিত। সত্যযুগে রাজ্য হারানো সুরথ রাজা ও স্বজন বিতাড়িত সমাধি বৈশ্য চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা পাহাড়ে ঋষি মেধসের নির্দেশে মর্ত্যলোকে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। আদিপুরাণেও উল্লেখ আছে, বসন্তকালে দুর্গাপূজার উৎপত্তি হয়েছে করলডেঙ্গা পাহাড়ে।
আর ত্রেতাযুগে অযোধ্যার রাজা দশরথপুত্র রামচন্দ্র বনবাসে গিয়ে আশ্বিন মাসে অকালবোধন করেছিলেন। দুর্গার সাহায্যে রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করতে অকালবোধন করেছিলেন।
গবেষক সচ্চিদানন্দ রায় চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মর্ত্যলোকে দেবী দুর্গা আতমন করেছিলেন চৈত্র মাসে অর্থাৎ বসন্তকাল। চৈত্র মাসে যে দুর্গাপূজা হয় তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। আর রাম শরৎকালে দেবীকে আবাহন করেছিলেন। এটি দেবী আগমনের কাল নয় বলে অকাল বোধন। এ পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। বাঙালিদের কাছে শারদীয় পূজাই সবচেয়ে বড় উৎসব।’
সনাতনীদের বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে।
পঞ্জিকা মতে, রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) মহাষষ্ঠীতে দেবীর বোধনের পর সোমবার সকালে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হবে মহাসপ্তমীর পূজা।
মঙ্গলবার মহাঅষ্টমী পূজা, সেদিন হবে সন্ধিপূজা। বুধবার সকালে বিহিত পূজার মাধ্যমে হবে মহানবমী পূজা।
বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) সকালে দর্পন বিসর্জনের পর প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবী দুর্গাকে দুর্গতিনাশিনী, শক্তিরূপিণী, মাতৃরূপিণীসহ কল্পিত নানা রূপে পূজা করেন। কারও কাছে দেবী দুর্গা দু:খ, জরা, সংকট বিনাশী সুখ প্রদায়িনী, কারও কাছে মমতাময়ী মা, কারও কাছে অসুরদলনী শক্তির আধার।
বাংলা পঞ্জিকামতে, কৈলাস থেকে এবছর মা দুর্গার মর্ত্যে আগমন হয়েছে গজে অর্থাৎ হাতিতে। এই গজই দেবীর সবচেয়ে সেরা বাহন। দেবীর আগমন গজে হলে মর্ত্যলোক সুখ শান্তিতে ভরে ওঠে। ধরাধামে আসে সমৃদ্ধি। বলা হয়, এরফলে পূর্ণ হয় ভক্তদের মনের ইচ্ছা। কথিত রয়েছে, পরিশ্রমের সুফল মেলে গজে দেবীর আগমন হলে। অতিবৃষ্টি বা অনবৃষ্টি হয় না। ফলন থাকে ঠিকঠাক।
কিন্তু দেবী ফিরবেন দোলা বা পালকিতে। শাস্ত্রমতে বলা হয়, ‘দোলায়াং মকরং ভবেৎ’। অর্থাৎ দোলা বা পালকিতে দেবী দুর্গার আগমন বা গমন হলে তার ফল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, রাজনৈতিক উত্থান-পতন।
চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিখিল কান্তি নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বরাবরের মতো এবারও উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। এটি বাঙালির সসার্বজনীন উৎসব। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সহিংসতা বিনাশের প্রার্থনা’ করা হবে এবারের পূজায়।’
পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এবার সারাদেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপ ও মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর সারাদেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি দুর্গাপূজা হয়েছিল। এ হিসেবে এবার ১ হাজার ৮৯৪টি দুর্গাপূজা বেশি হচ্ছে।