Sunday 28 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এবার ১৯ এসএসসি পরীক্ষার্থীর ‘ফল জালিয়াতি’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৯:৩৫

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফল কেলেঙ্কারি পিছু ছাড়ছে না চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের। এইচএসসি পরীক্ষায় নিজের ছেলেকে বেশি নম্বর দিয়ে ফলাফল জালিয়াতির মামলায় সাবেক সচিব গেছেন কারাগারে। এর মধ্যে আবার এসএসসির ১৯ পরীক্ষার্থীর ৩৪টি উত্তরপত্রে নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ পেয়ে শিক্ষাবোর্ডে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে এর প্রমাণ মিলেছে বলেও জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে অভিযান চালায় দুদকের চট্টগ্রামের একটি দল। অভিযান শেষে দুদকের সহকারী পরিচালক সাঈদ মোহাম্মদ ইমরান হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এবছরের এসএসসি পরীক্ষায় ১৯ পরীক্ষার্থীর ৩৪টি উত্তরপত্রে নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ পেয়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের অভিযানে এখানে অনিয়ম পেয়েছি। অনিয়মের বিষয়ে আমাদের যেটা করণীয় সেটা আমরা কমিশনকে রিপোর্ট দেব। মূলত এখানে অনিয়মটা হয়েছে প্রোগ্রামার ও সহকারী প্রোগ্রামারের রুম থেকে। এখানে টেম্পারিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ আসা উত্তরপত্রগুলোতে মূল খাতা এবং টপ শিটে নম্বর ঠিক আছে। কিন্তু কম্পিউটারে ইনপুট দেওয়ার সময় নম্বর বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, অভিযানে দুদক কর্মকর্তারা যেসব উত্তরপত্রে নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো খতিয়ে দেখেছেন। যাদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পাশাপাশি কিছু নথিপত্রও জব্দ করা হয়েছে।

সাঈদ ইমরান সাংবাদিকদের বলেন, ‘চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে সিস্টেম অ্যানালিস্ট নেই। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড থেকে অ্যাসিসটেন্ট অ্যানালিস্ট এখানে এসেছিলেন। এ অনিয়ম প্রথমে তার চোখে পড়ে। উনি বিষয়টি চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ অনিয়মের বিষয়টি জানতে পেরে চেয়ারম্যান বরাবরে একটি পত্র দেন এবং তার প্রেক্ষিতে তিনি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এ মাসের ১৮ তারিখ প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও উনারা (তদন্ত কমিটির সদস্য) সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন। তার প্রেক্ষিতে আরও ১৫ কার্য দিবস সময় বাড়ানো হয়েছে। উনাদের বিভাগীয় তদন্ত কার্যক্রম চলমান আছে, আমরা আমাদের কাজ করছি।’

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে কর্মরত কয়েকজনের ‘একটি চক্র’ এ ফলাফল জালিয়াতিতে জড়িত বলে ধারণা দুদকের এ কর্মকর্তার। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘এসএসসির খাতা পুনঃনিরীক্ষণের সময় এটা ধরা পড়েছিল। আমাকে ৩১ অগাস্ট পরীক্ষা শাখা থেকে বিষয়টি জানানো হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর আমি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। এ বিষয়ে দুদক আজ (রোববার) জানতে চেয়েছে। আমি বোর্ডে আমার পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের অবহিত করেছি।’

উল্লেখ্য, গত ১০ জুলাই সারাদেশে একযোগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর, তিন পার্বত্য জেলা এবং কক্সবাজার মিলিয়ে এবার পরীক্ষার্থী ছিল মোট ১ লাখ ৪১ হাজার ৩৩ জন। উপস্থিত ছিলেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৩৮৮ জন। প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, চলতি বছরে পাস করেছেন ১ লাখ ১ হাজার ১৮১ জন। ফেল করেছেন ৩৯ হাজার ২০৭ জন।

এর পর ঘোষিত সময় অনুযায়ী ১১ থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে ফলাফল নিয়ে আপত্তি জানিয়ে ৭৮ হাজার ১৯২টি উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের জন্য ৩২ হাজার ৩০৭ জন পরীক্ষার্থী আবেদন করেন। ১০ আগস্ট পুনঃনিরীক্ষণের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এতে ফল পরিবর্তন হয় এক হাজার ৬৬৯ জন শিক্ষার্থীর। পুনঃনিরীক্ষণে উত্তরপত্রের ফল পরিবর্তন হয় ১ হাজার ৭৪২টি। জিপিএ পরিবর্তন হয় ৬৪৬ জনের এবং ফেল থেকে পাস করেছে ৬৪ জন। সেইসঙ্গে নতুন করে জিপিএ ৫ পান আরও ৬৫ জন।

এর আগে, নিজের ছেলের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে হওয়ায় এক মামলায় গত ১৭ জুন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথ কারাগারে যান। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব অধ্যাপক ড. এ কে এম সামছু উদ্দিন আজাদ নগরীর পাঁচলাইশ থানায় নারায়ণ চন্দ্র নাথসহ চারজনের বিরুদ্ধে এ জালিয়াতির মামলা করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- অধ্যাপক নারায়ণের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ (২০), শিক্ষাবোর্ডের সাবেক সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খান (৬১) এবং সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুস্তফা কামরুল আখতার (৬১)।

২০২২ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। সেই ফলাফল প্রকাশ হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর। দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৫, ৪৬৬, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ৩৪ ধারা এবং পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এর ৫, ৬, ১২ ও ১৩ ধারায় করা ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ফলাফল প্রকাশের আগে যে কোনোসময় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জালিয়াতি করে নক্ষত্র দেবনাথের ফলাফল পরিবর্তন করেন। নক্ষত্র ছাড়া বাকি তিনজন জালিয়াতি সংঘটনের সময় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে স্ব স্ব পদে দায়িত্বরত ছিলেন।

নারায়ণ চন্দ্র নাথ ২০১৯ সাল থেকে প্রায় পাঁচ বছর ধরে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, সচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২২ সালে তার ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তখন নারায়ণ সচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ফলাফল ঘোষণার পর অভিযোগ ওঠে, নারায়ণ চন্দ্র নাথ তার ছেলেকে জালিয়াতির মাধ্যমে জিপিএ-ফাইভ পাইয়ে দিয়েছেন। কে বা কারা নক্ষত্রের ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করলে তার মা বনশ্রী দেবনাথ নগরীর পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ফলে বিতর্ক আরও জোরালো হয়। এ অবস্থায় ২০২৪ সালের জুনে জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৯ জুলাই নারায়ণকে শিক্ষাবোর্ড থেকে সরিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) বিভাগের চট্টগ্রামের পরিচালক পদে বসানো হয়।

এর পর গতবছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) বিভাগের শৃঙ্খলা অণুবিভাগের সিনিয়র সহকারি সচিব শতরূপা তালুকদারের সই করা নির্দেশনায় বলা হয়, তদন্তে নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এজন্য তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী মামলাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া ও নক্ষত্রের ফলাফল বাতিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এর ভিত্তিতে জালিয়াতির দায়ে ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাউশি’র চট্টগ্রামের পরিচালক পদ থেকে নারায়ণকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। তার ছেলের ফলাফল বাতিল করা হয়। এরপর নারায়ণসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড টপ নিউজ ফল জালিয়াতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর