Tuesday 30 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘কল্কি-তাঁতওয়া’ ও ‘ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড’
থিমের টানে মণ্ডপগুলোতে ছুটছে জনস্রোত

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২২:৩৩ | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২২:৫৩

শারদীয় দুর্গোৎসব, চট্টগ্রাম। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সনাতন ধর্ম অনুসারে, চতুর্যুগের শেষ যুগ কলিযুগের শেষের দিকে আবির্ভূত হবেন এক অবতার, যার নাম কল্কি। এই কল্কি হলেন ভগবান বিষ্ণুর দশম ও শেষ অবতার, যিনি কলিযুগের সমাপ্তি ঘটাতে এবং সত্যযুগের সূচনা করতে আবির্ভূত হবেন। তিনি অধর্মের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে ধর্ম পুনরুদ্ধার করবেন। কল্কি দেবদত্ত নামক সাদা ঘোড়ায় আরোহণ করে একটি অগ্নিময় তরবারিধারী নিয়ে আর্বিভূত হবেন।

সনাতন ধর্মগ্রন্থ বিষ্ণু পুরাণ, ভগবত পুরাণ এবং কল্কি পুরাণে বর্ণিত এ কল্কি ভাবনা বা বিশ্বাসের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী লেইনের দুর্গাপূজায়। দুই যুগ আগে বন্দরনগরীতে এই হাজারী লেইনই থিম পূজোর মধ্য দিয়ে গতানুগতিক ধারা ভেঙে দুর্গোৎসবের সূচনা করেছিল। হাজারী লেইনের পথ ধরে এখন চট্টগ্রামে অন্তত অর্ধশত মণ্ডপে কাল্পনিক, পৌরাণিক, ধর্মীয় কিংবা চিরায়ত নানা ভাবনায় থিম পূজার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে উৎসবের রঙ। আর থিমের বৈচিত্র্য দেখতে মণ্ডপগুলোতে যেন প্রতিরাতে তৈরি হচ্ছে জনস্রোত।

বিজ্ঞাপন

হাজারী লেইনে দুই বছর আগের থিম পূজার অনুষঙ্গ ছিল ‘প্রাণ-প্রকৃতির টানে’। ব্যস্ত নগরের বুকে তারা ফিরিয়ে এনেছিলেন সবুজ-শ্যামল গ্রামের নানা রূপ। নগরীর আগ্রাবাদের মোগলটুলির একটি মণ্ডপে প্রাণ-প্রকৃতির ছোঁয়ার আবহমান কালের চিরায়ত তাঁত শিল্পকে ফিরিয়ে এনেছেন দুর্গোৎসবের মঞ্চে, জনমানুষের হৃদয়ে দিয়েছেন হারানো ঐতিহ্যের সুর।

তাদের থিমের নাম ‘তাঁতওয়া’। তাঁতীদের ব্যবহৃৎ রঙ, চরকা, সূতা আর তৈরি করা শাড়ির স্টলের আকারে সাজানো হয়েছে পূজামণ্ডপ। এর মধ্য দিয়ে দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে জনমানুষের সামনে হাজির করা হয়েছে বলে জানালেন আয়োজকরা।

শারদীয় দুর্গোৎসবে চট্টগ্রামের মণ্ডপগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন থিমে। ছবি: সংগৃহীত

শারদীয় দুর্গোৎসবে চট্টগ্রামের মণ্ডপগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন থিমে। ছবি: সংগৃহীত

আবার ৭৮ বছরের প্রাচীন চট্টগ্রামের দক্ষিণ নালাপাড়ায় পূজা উদযাপন পরিষদ’ এবার ঐতিহ্যবাহী ছৌ নৃত্য আর রামায়নের লঙ্কাকাণ্ডকে সমন্বিত করে ‘ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড’ থিম প্রদর্শন করছে। প্রাচীন ভারতের আদিবাসীদের যুদ্ধনৃত্য হলো ছৌ নাচ, যার মধ্য দিয়ে রামায়ণ, মহাভারত বা ধর্মীয় অ্যাখ্যান এবং গ্রাম্যগীতির কথা পরিবেশন করেন শিল্পীরা। ২০১০ সালে ছৌ নৃত্য ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেয়। রামায়ণ মতে, লঙ্কাকাণ্ড মানে সীতা হরণের পর তাকে উদ্ধারে লঙ্কায় যাওয়া সীতাপতি রামচন্দ্র ও লঙ্কাপতি রাবনের মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধের আখ্যান।

মাটি, চট ও গাছের বাকল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে এ পূজামণ্ডপ। আর পোশাক পরিচ্ছদ বা অবয়বে ছৌ নৃত্যের শিল্পীদের প্রতীকী ভাব রাখা হয়েছে পুরোপুরিভাবে। পূজার থিম প্রসঙ্গে দক্ষিণ নালাপাড়া পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্য রাজীব বিশ্বাস রাজা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের থিমের নাম ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড। আমাদের বার্তাটা হচ্ছে, দুষ্টের দমনের মধ্য দিয়ে ধর্মের বিজয়। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আমরা এই থিম নির্বাচন করেছি।’

নগরীর আগ্রাবাদ একতা গোষ্ঠীর এবারের আয়োজন ‘যান্ত্রিক নগরে পল্লী কথা’। ককশিট, বাঁশ, কাঠে পল্লী জীবনের নানা অনুষঙ্গ ফুটিয়ে তুলে তৈরি করা হয়েছে পূজামণ্ডপ।

ফেসবুক পেইজ ‘চট্টগ্রাম শারদীয় দুর্গাপূজা’ এবারের বৈচিত্র্যময় ও নান্দনিক থিমের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রামের ৫০টি পূজামণ্ডপ নির্বাচন করেছে। হাজারী লেইন, দক্ষিণ নালাপাড়া, আগ্রাবাদ একতা গোষ্ঠীর মতো বড়ো মণ্ডপগুলোতে স্থান পেয়েছে এতে।

শারদীয় দুর্গোৎসবে চট্টগ্রামের মণ্ডপগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন থিমে। ছবি: সংগৃহীত

শারদীয় দুর্গোৎসবে চট্টগ্রামের মণ্ডপগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন থিমে। ছবি: সংগৃহীত

এছাড়া, বিভিন্ন মণ্ডপের থিমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও আছে- ফিরিঙ্গিবাজার শিববাড়ি লেইনে ‘দ্বারকা’, এনায়েতবাজার সার্বজনীন মণ্ডপে ‘চালচিত্র’, খলিফাপট্টি সার্বজনীন মণ্ডপে ‘অন্তরাগ’, উত্তর কাট্টলী সার্বজনীন মণ্ডপে ‘রঙ্গমঞ্চ’, পতেঙ্গা শ্যামা সংঘের ‘ধ্বংসের মেঘে শান্তির ঘুড়ি’, আদি গঙ্গাবাড়িতে ‘গোলকধাঁধা’, রাজাপুর লেইনে ‘যত মত তত পথ’, পটিয়া রামকৃঞ্চ মিশনে ‘চির চেনা দুর্গা’, পটিয়া মিলনমন্দিরে ‘জীবনত্রয়ী’, বেটারি গলিতে ‘পথের পাঁচালি’, পাথরঘাটা সতীশ বাবু লেইনে ‘তুমি আসবে বলে’, টেরিবাজার বাই লেইনে ‘ফেরিকথা’, গোসাইলডাঙা তরুণ সংঘের ‘অবক্ষয়’, দক্ষিণ কাট্টলী দুর্গাপাড়া যুবগোষ্ঠীর ‘জীবন ঘড়ি’, রুমঘাটা প্রগতি সংঘের ‘কন্যাদান’, মোহরা মুক্তাজয়ন্তী সার্বজনীন ক্লাবের ‘অকাল বোধন’।

চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিখিল কান্তি নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাত্ত্বিক পূজাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি, যেগুলো সত্যিকারের শাস্ত্রমতে পূজার আচার মেনে হয়। কিন্তু থিম পূজাও এখন বেশি জনপ্রিয়। মূলত পূজার যে উৎসব সেটা থিমের মাধ্যমেই বেশি হচ্ছে। চট্টগ্রামে এবারও বরাবরের মতো বড় বড় মণ্ডপগুলোতে থিম পূজার আয়োজন করা হয়েছে। এসব মণ্ডপে প্রচুর লোক সমাগম হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। ভক্তদের নিরাপত্তায় এবার তারা যথেষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে।’

আশ্বিনের শুক্লপক্ষের অমাবস্যার দিনে গত ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। আর দেবীপক্ষের সমাপ্তি হবে পঞ্চদশ দিনে কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজার মধ্যে দিয়ে। এর মাঝে ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠীতে বোধন। আর দশম দিন, অর্থাৎ দশমীতে বিসর্জন। দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা এই পাঁচদিনই চলে। তবে বাঙালি সমাজে বেশি প্রচার পাওয়া আশ্বিনের এই দেবীবন্দনা মূল দুর্গাপূজা নয়। এটি ‘অকাল বোধন’ নামে উল্লেখ আছে শাস্ত্রে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মূল দুর্গাপূজা হয় বসন্তকালে, যেটি বাসন্তী পূজা নামে অভিহিত। সত্যযুগে রাজ্য হারানো সুরথ রাজা ও স্বজন বিতাড়িত সমাধি বৈশ্য চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা পাহাড়ে ঋষি মেধসের নির্দেশে মর্ত্যলোকে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। আদিপুরাণেও উল্লেখ আছে, বসন্তকালে দুর্গাপূজার উৎপত্তি হয়েছে করলডেঙ্গা পাহাড়ে।

আর ত্রেতাযুগে অযোধ্যার রাজা দশরথপুত্র রামচন্দ্র বনবাসে গিয়ে আশ্বিন মাসে অকালবোধন করেছিলেন। দুর্গার সাহায্যে রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করতে অকালবোধন করেছিলেন।

শারদীয় দুর্গোৎসবে চট্টগ্রামের মণ্ডপগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন থিমে। ছবি: সংগৃহীত

শারদীয় দুর্গোৎসবে চট্টগ্রামের মণ্ডপগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন থিমে। ছবি: সংগৃহীত

গবেষক সচ্চিদানন্দ রায় চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মর্ত্যলোকে দেবী দুর্গা আগমন করেছিলেন চৈত্র মাসে অর্থাৎ বসন্তকালে। চৈত্র মাসে যে দুর্গাপূজা হয় তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। আর রাম শরৎকালে দেবীকে আবাহন করেছিলেন। এটি দেবী আগমনের কাল নয় বলে অকাল বোধন। এ পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। বাঙালিদের কাছে শারদীয় পূজাই সবচেয়ে বড় উৎসব।’

বরাবরের মতো মহাষষ্ঠীর দিন অর্থাৎ ২৮ সেপ্টেম্বর থেকেই বন্দরনগরী চট্টগ্রামে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে। এর পরের দুইদিনে মহাসপ্তমী ও মহাষ্টমীতে পূজামণ্ডপগুলোতে রীতিমতো মানুষের ঢল নেমেছে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবী দুর্গাকে দুর্গতিনাশিনী, শক্তিরূপিণী, মাতৃরূপিণীসহ কল্পিত নানা রূপে পূজা করেন। কারও কাছে দেবী দুর্গা দুঃখ, জরা, সংকট বিনাশী সুখ প্রদায়িনী, কারও কাছে মমতাময়ী মা, কারও কাছে অসুরদলনী শক্তির আধার।

বাংলা পঞ্জিকামতে, কৈলাস থেকে এবছর মা দুর্গার মর্ত্যে আগমন হয়েছে গজে অর্থাৎ হাতিতে। এই গজই দেবীর সবচেয়ে সেরা বাহন। দেবীর আগমন গজে হলে মর্ত্যলোক সুখ শান্তিতে ভরে ওঠে। ধরাধামে আসে সমৃদ্ধি। বলা হয়, এর ফলে পূর্ণ হয় ভক্তদের মনের ইচ্ছা। কথিত রয়েছে, পরিশ্রমের সুফল মেলে গজে দেবীর আগমন হলে। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি হয় না। ফলন থাকে ঠিকঠাক।

কিন্তু দেবী ফিরবেন দোলা বা পালকিতে। শাস্ত্রমতে বলা হয়, ‘দোলায়াং মকরং ভবেৎ’। অর্থাৎ দোলা বা পালকিতে দেবী দুর্গার আগমন বা গমন হলে তার ফল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি ও রাজনৈতিক উত্থান-পতন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

কল্কি-তাঁতওয়া ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড জনস্রোত দুর্গাপূজা মণ্ডপ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর