সিলেট: সবুজে ঘেরা পাহাড়, ঝর্ণার কলকল ধ্বনি আর চিরচেনা চা-বাগানের অবারিত বিস্তার — এই রূপেই পরিচিত পূণ্যভূমি সিলেট। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ভূমি— যেখানে শুয়ে আছেন হযরত শাহ জালাল (রহ.) ও হযরত শাহ পরান (রহ.)-এর মতো অলিরা। যে কারণে সিলেট কে পূণ্য ভূমি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একবছর পর সেই শহর বদলাতে শুরু করেছে। ফুটপাত, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও পর্যটন— সবখানে এখন প্রত্যাশার নতুন আলো ফুটে উঠেছে। আর এই বদলানোর কারিগর হিসেবে যারা রয়েছেন, তারা হলেন- সিলেটের জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার ও সাবেক মেয়র। কিছুদিন ধরে সিলেটে জেলা প্রশাসন (ডিসি), সিটি করপোরেশন (সিসিক) ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নীরবে নয়, বরং কর্ম দিয়ে বলেছে— ‘পরিবর্তন সম্ভব।’
সিলেটে প্রশাসনিক পালাবদলের পর স্পষ্টভাবে একটি পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। সিলেটের নাগরিক জীবনকে রীতিমতো অসহনীয় করে তোলা এসব সমস্যার মুলোৎপাটনে মাঠে নেমেছেন প্রশাসনের নবনিযুক্ত দুই শীর্ষ কর্মকর্তা ও সাবেক সিসিক মেয়র। একজন জেলা প্রশাসক মো. সারোয়ার আলম, অপরজন সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরী পিপিএম এবং সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
এই তিনজনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ঘিরে নগরজুড়ে চলছে নানা আলোচনা। তারা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকেও একটি অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ডিসি সারওয়ার আলম জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব নেন। প্রথম দিনেই সাদা পাথর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ পাথর উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টক জব্দ করার মাধ্যমে তিনি আলোচনায় আসেন। ওই সময় তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যে-ই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করবে, তার জীবন ফানা-ফিল্লাহ করে দেবেন। এরপর থেকে পাথরকাণ্ডে জড়িতরা গা ঢাকা দিতে শুরু করে।
ডিসির উদ্যোগে সিলেট নগরের বিভিন্ন অংশে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, খাল ও ফুটপাত উদ্ধার, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সরাসরি অংশগ্রহণ, ওসমানী হাসপাতাল পরিদর্শন, বিমানবন্দরে ওয়াইফাই চালু এবং পরিবেশ সংরক্ষণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এমনকি তিনি নিজে হাতে ঝাড়ু নিয়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নিয়ে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয়, মানবিক পদক্ষেপেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন ডিসি সারওয়ার। জকিগঞ্জ উপজেলায় অমানবিক দেয়াল অপসারণ করে অবরুদ্ধ থেকে একটি পরিবারকে মুক্ত করে সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
অন্যদিকে, নতুন পুলিশ কমিশনার আবদুল কুদ্দুস দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেন, ‘শুধু কঠোরতা নয়, আমরা জনগণের সেবায় প্রযুক্তি আনছি।’ তিনি জানান, সিলেটে খুব শিগগিরই চালু হচ্ছে ‘GenieA’ নামের একটি স্মার্ট মোবাইল অ্যাপ, যার মাধ্যমে নাগরিকরা জরুরি অবস্থায় পুলিশের সহায়তা পাবেন, লোকেশন শেয়ার করতে পারবেন এবং অভিযোগ জমা দিতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘১২ লাখ নগরবাসী একটি যানজট মুক্ত নিরাপদ নগরী চান। সবাই চান নির্ভয়ে ফুটপাতে হাঁটতে, চলাচল করতে। এই লক্ষ্যে আমরা ফুটপাতকে হকারমুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছি। এছাড়া রাস্তায় যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছি। সেইসঙ্গে টেকসই ও নিরাপদ নগরী গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।’
এছাড়া, সিলেট মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তিনি মাদক, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই প্রতিরোধে কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়েছেন। আর অবৈধ যানের বিরুদ্ধে অলআউট অ্যাকশন, থানা পর্যায়ে দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলায় সংশ্লিষ্টদের বরখাস্ত করার পদক্ষেপ তাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে।
তবে প্রশাসনের এই সক্রিয় অভিযানের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম রয়ে গেছে আলোচনায়— সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। যদিও বর্তমানে তিনি পদে নেই, তারপরও ফুটপাত ও ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশা বন্ধে তিনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন প্রশাসনের সঙ্গে। তিনি নগরবাসীকে নিয়ে পদযাত্রাও করেছেন। যদিও মেয়র পদ থেকে তার অপসারণ রাজনৈতিক বিতর্ক ডেকে আনে, তবুও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও নগরের জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতা একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয়, যেটি এখনকার প্রশাসন চাইলে ব্যবহার করতে পারে।
এই তিন ব্যক্তির অবস্থান, অভিজ্ঞতা ও উদ্যোগ ভিন্ন হলেও লক্ষ্য অভিন্ন— সিলেটকে বাসযোগ্য, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ নগরে পরিণত করা। একজন নতুন ডিসি প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে, আরেকজন পুলিশ প্রধান আইন প্রয়োগ, প্রযুক্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং তৃতীয়জন আগের অভিজ্ঞতায় পরিকল্পনার ভিত্তি গড়ে দিয়ে এই শহরের চেহারা পালটে দিচ্ছেন। এখন দেখার বিষয়, এই ত্রিমুখী প্রচেষ্টা কতটা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে নগরবাসীর জীবনে।
এই ত্রিমুখী নেতৃত্ব সিলেটে এক ধরনের ভারসাম্য তৈরি করছে। মাঠে প্রশাসন, স্ক্রিনে পুলিশ, পরিকল্পনায় অভিজ্ঞতা— এই সমন্বয় সিলেটবাসীর কাছে এক নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। তবে এই পথচলা সহজ নয়। সিলেটে দীর্ঘদিনের দখল সংস্কৃতি, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং নাগরিক উদাসীনতা— সবকিছুই বড় চ্যালেঞ্জ। ডিসি হয়তো অভিযান চালাচ্ছেন, পুলিশ হয়তো প্রযুক্তি এনেছে, আর অভিজ্ঞ মেয়র হয়তো অভিজ্ঞতা দিচ্ছেন। তবে নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও স্থানীয় রাজনীতি একত্রে না এলে এই পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী হয়ে যেতে পারে বলে মত সচেতন মহলের।
তাদের মতে, সিলেট আজ আর শুধুমাত্র হাওর, পাহাড় আর প্রবাসীদের নগর নয়। এটি এখন একটি সচেতন, সচল ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় ভরা শহর। এই পরিবর্তনের রূপকার তিনজন— জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার ও এক সাবেক মেয়র। সময়ই বলে দেবে, এই ত্রিমুখী নেতৃত্ব কেবল আলোচনার বিষয় হয়েই থাকবে, নাকি সত্যিই সিলেটের ভাগ্য বদলে দেবে।