ঢাকা: পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের ১ নম্বর শ্রীশ দাস লেনে দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং। এটি শুধু একটি দোতলা পুরনো ভবন নয়—বরং একসময়ে বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মুক্তচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। বহু কবি-সাহিত্যিকের সৃষ্টির আঁতুড়ঘর, শিল্পীদের আড্ডার স্থান আর রাজনৈতিক আলোচনার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই বোর্ডিং। নানা ঘটনার সাক্ষী এই স্থানটি আজও স্বকীয়তা ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আড্ডাঘর বিউটি বোর্ডিং। ছবি: সংগৃহীত
ব্যবসায়ীর উদ্যোগ থেকে সাংস্কৃতিক আড্ডাঘর
দেশভাগের আগে ভবনটি ছিল জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের সম্পত্তি। সেখানেই চলত সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। দেশভাগের পর নলিনী মোহন সাহা জায়গাটি কিনে নেন এবং ১৯৪৮-৪৯ সালে তার বড় মেয়ে বিউটির নামানুসারে ‘বিউটি বোর্ডিং’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমদিকে এটি ছিল আবাসিক বোর্ডিং ও রেস্তোরাঁ, তবে খুব দ্রুতই এর পরিধি ছড়িয়ে যায় সংস্কৃতির জগতে।
কে এই নলিনী মোহন সাহা
বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা নলিনী মোহন সাহা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তামাকপাতা বিক্রি করতেন এবং ব্যবসার কাজে কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। অত্যন্ত বন্ধুপ্রিয় ও রসিক মানুষ হওয়ায় তার অনেক বন্ধু, বিশেষ করে মারোয়ারী ব্যবসায়ীরা ঢাকায় এলে থাকার সমস্যা হতো। তাদের সুবিধার্থে তিনি মূলত এই বোর্ডিং তৈরি করেছিলেন। যা আবাসিক সুবিধা ও রেস্তোরাঁ হিসেবে পরিচালিত হয়।

বিউটি বোর্ডিংয়ে দর্শনার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
সাহিত্য-সংস্কৃতির আড্ডাঘর
শহীদ কাদরী নিয়মিত এখানে আসতেন, সৈয়দ শামসুল হক লিখতেন তার নির্দিষ্ট টেবিলে। এক সময়ের আড্ডায় হাজির হতেন শামসুর রাহমান, আহমেদ ছফা, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ অসংখ্য কবি ও সাহিত্যিক। চলচ্চিত্র ও সংগীত জগতেরও প্রিয় ঠিকানা ছিল এটি। আবদুল জব্বার এখানে বসেই লিখেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর চিত্রনাট্য। সমর দাস সৃষ্টি করেছিলেন কালজয়ী গান। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী—সবাই মিশে গিয়েছিলেন এই আড্ডায়।

জরাজীর্ণ বিউটি বোর্ডিং। ছবি: সংগৃহীত
রাজনীতি ও বিপ্লবী আলোচনার কেন্দ্র
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি—সব ক্ষেত্রেই এখানে জড়ো হয়েছেন রাজনৈতিক কর্মীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কর্নেল অলি আহাদ এবং গাজীউল হকসহ অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছিল এই বোর্ডিংয়ে। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, কমরেড আব্দুল মতিন, কর্নেল অলি আহাদ এবং সাইফুদ্দীন মানিকসহ অনেকেই এখানে আড্ডা দিতেন। দেশভাগের আগে এখানে আসতেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও।

জৌলুস হারিয়েছে বিউটি বোর্ডিং
ভূমিখেকোদের হুমকি ও প্রতিরোধের অঙ্গীকার
বর্তমানে ঐতিহাসিক এই স্থানের দিকে নজর পড়েছে ভূমিখেকোদের। জরাজীর্ণ ভবন ভেঙে দিতে চায় অনেকে। তবুও রক্ষকরা লড়ে যাচ্ছেন ইতিহাসকে ধরে রাখতে। দৃঢ় সংকল্পে বিজয় গোপাল বলেন, ‘আমি চাই যুগ যুগ ধরে এ ইতিহাস ঐতিহ্যের স্থানটা জীবিত থাকুক।’
বিউটি বোর্ডিং কেবল একটি রেস্তোরাঁ বা বোর্ডিং নয়, এটি বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও স্মৃতির এক জীবন্ত দলিল। এর প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে এক সমৃদ্ধ অতীতের গল্প, যা আজও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা যোগায়।