Friday 03 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গাছ নিধনে চর বনায়ন ধ্বংস

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:১৯ | আপডেট: ৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:৫২

গাছ নিধনের চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ও গাবুরা ইউনিয়নের সংযোগস্থল চৌদ্দরশি ব্রিজের পশ্চিমে খোলপেটুয়া নদীর তীরে প্রায় ৩০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা চর বনায়নের গাছ কেটে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। দিনের পর দিন নির্বিচারে এসব গাছ কেটে নেওয়া হলেও এ বিষয়ে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

স্থানীয়রা বলছেন, দিন-রাত সমানতালে করাত, কুড়াল দিয়ে নিঃশব্দে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুই ইউনিয়নের সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র। অপরদিকে নদীর চরে বনায়ন অঞ্চলে যেখানে-সেখানে গর্ত খুঁড়ে মাছ শিকারের ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। শিকারিরা তাদের সুবিধার্থে বনায়নের গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলছেন। গর্তে পানি আটকে থাকায় সেখানে নতুন গাছও জন্মাতে পারছে না। ফলে দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে চর বনায়ন। অথচ বহু বছর ধরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ছোট-বড় দুর্যোগে প্রাচীর হিসেবে উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষা করছে চর বনায়নের এসব গাছ।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়দের অভিযোগ, এ বিষয়ে বারবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসনকে অবগত করা হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ফলে, গাছ কাটা অব্যাহত থাকায় নদীর চরটি ধীরে ধীরে উজাড় হয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বনের ভেতরে নানা প্রজাতির ছোট-বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কাটা গাছের ডালপালা ফেলে রাখা হয়েছে বনের ভেতরে। এ ছাড়া অসংখ্য গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে, যা জোয়ারের সময় পানিতে ভরে যায়। স্থানীয়দের দাবি, এসব গর্তে জোয়ারে রেনুপোনা আসে, যা পরে ধরে বাজারে বিক্রি করা হয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, গাবুরা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের খোলপেটুয়া, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গাজী পাড়া এবং ওই চরে গড়ে ওঠা বনের কাছাকাছি বসবাসরত পরিবারগুলো এই বনের গাছ নিধনে মেতে উঠেছে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, খোলপেটুয়া নদীতে প্রায় ৭০০ বিঘা জায়গাজুড়ে একটি বড় চর জেগে উঠেছে। এখানে প্রথমে স্থানীয়রা বনায়ন শুরু করলেও পরবর্তীতে এটি সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়ায় নদীর জোয়ারে ভেসে আসা নানা গাছের ফল চরে আটকে গাছগুলো জন্ম নেয়। এতে নদীর প্রায় ৭০০ বিঘা জায়গাজুড়ে বেড়িবাঁধ ঘেঁষে চরে গড়ে উঠে সবুজ ঘন বন। তবে গড়ে ওঠা সেই সবুজ বন আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

তাদের অভিযোগ, স্থানীয় একটি চক্র প্রথমে ওই চরে যেখানে-সেখানে গর্ত খুঁড়ে মাছ শিকারের সুবিধার্থে ফাঁদ তৈরির জন্য বনায়নের ওই গাছ কাটা শুরু করেন। পরে পার্শ্ববর্তী গাবুরার কয়েকটি এলাকার কিছু মানুষও এই ধ্বংসযজ্ঞে যোগ দেন। এভাবে কয়েক মাসের মধ্যে কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালী গ্রামের খোকন সরদার বলেন, ‘আগে চরে প্রচুর গাছ ছিল। এখন চর প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়েছে। গাছ কাটার শব্দ যাতে লোকালয়ে না আসে, সেজন্য করাত দিয়ে কাটা হয়। আবার অনেক সময় গাছ কেটে রেখে যায়, দুই-এক দিন পর সেই গাছ নিয়ে যায়। যাতে মানুষকে বোঝানো যায় গাছটা মারা গিয়েছে, তাই মরা গাছ কেটে নেওয়া হচ্ছে।’

স্থানীয় বসবাসকারী তরুণ মোস্তফা আল আমিন বলেন, খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ঘেঁষে প্রায় ৭০০ বিঘা জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা বনটি ধ্বংসের পথে। নদীপাড়ের মানুষ জ্বালানি কাঠ, ঘর তৈরির কাঠ আর আসবাবপত্রের জন্য পুরোপুরি এই বনের ওপর নির্ভর করে। এছাড়াও মাছ শিকারিদের দৌরাত্ম্যে নতুন গাছ জন্মাচ্ছে না ওই বনে। এভাবে গাছ কাটা চলতে থাকলে বন আর টিকবে না। অথচ বহু বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রাচীর হিসেবে উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষা করছে চর বনায়নের এসব গাছ।

একই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আবু মুছা অভিযোগ করেন, দিনের বেলায় এসে গাছ কেটে রেখে যায়, আর জোয়ারের সময় নৌকায় করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী গাবুরা ইউনিয়ন থেকেও নৌকা করে এসে অনেকে কেউড়া ফল সংগ্রহের নামে বড় বড় গাছ কেটে নিয়ে যায়। নিষেধ করলে শোনে না। আগে বন রক্ষায় একটা কমিটি ছিল, এখন আর নেই। সেই সুযোগে চলছে নির্বিচারে গাছ কাটা।

এ বিষয়ে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ৮৩ নং পশ্চিম পাতাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস.এম রুহুল কুদ্দুস অভিযোগ করে বলেন, গাবুরার খোলপেটুয়া গ্রামের কিছু লোক,পদ্মপুকুরের ৮ নং ওয়ার্ড পূর্ব পাতাখালি গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার ২৫-৩০জন বাসিন্দা এবং ওই বন সংলগ্ন ওয়াপদার উপরে বসবাসরত লোকজন সরাসরি এ বন নিধনের কাজে জড়িত। এছাড়াও স্থানীয় কয়েকজন চিহ্নিত মাদকসেবী মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে এ বনের গাছ চুরি করে কেটে বিক্রি করে। আবার হরিণা চিংড়ীর রেণু ধরার জন্য নির্ধারিত কিছু ব্যক্তি এ বনের মধ্যে গাছ কেটে শতাধিক গর্ত তৈরি করেছে। এর ফলে একদিকে ক্রমাগত পুরাতন গাছ নিধন হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন চারাগাছ জন্মাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ইতোপূর্বে যারা এ বন দেখভালের নামকাওয়াস্তে দায়িত্বে ছিলেন, তারাও ব্যক্তিস্বার্থে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এ বন উজাড়ের কাজে লিপ্ত ছিলেন বলে জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন,‘প্রাকৃতিকভাবে এবং কিছুটা এনজিওর সহযোগিতায় গড়ে ওঠা এ বন রক্ষার্থে চেয়ারম্যান, মেম্বার, স্থানীয় লোকজন ও এনজিওর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে নখ,দাঁতহীন সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির কর্মকর্তাদের গর্জনও। এখন দরকার প্রশাসনিক ও পুলিশি ব্যবস্থা। অন্যথায় গাছ নিধন হলে জেগে ওঠা চর বিলীন হবে, হবে নদী ও ওয়াপদা ভাঙন। ঠেকানো যাবেনা জলোচ্ছ্বাস এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়।’

পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথনেট গ্লোবাল-এর নির্বাহী পরিচালক সোহানুর রহমান বলেন, বনের ভেতরে গর্ত করে মাছের পোনা ধরা আর নির্বিচারে গাছ কাটা পরিবেশের জন্য ভয়ংকর হুমকি। এতে নতুন করে গাছ জন্মায় না। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়। অথচ এসব সামাজিক বন উপকূল রক্ষার প্রাকৃতিক বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে। বন ধ্বংস হলে পরিবেশের ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম বলেন, ‘খোলপেটুয়া নদীর চরে গড়ে ওঠা বনায়নের গাছ কেটে নেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিছু দুর্বৃত্ত চুরি করে এসব গাছ কাটছে এবং পাচার করছে। আমরা এই কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ধরার চেষ্টা করছি।’

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ রনী খাতুন জানান, ‘চর বনায়নের এ ধরনের বেআইনি গাছ কাটার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এখনই স্থানীয় দুই চেয়ারম্যান ও সামাজিক বন বিভাগকে জানাচ্ছি। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে প্রশাসনও সরাসরি ব্যবস্থা নেবে।’

সারাবাংলা/জিজি

চর বনায়ন ধ্বংস

বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আরও ২৬৩
৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:৩৯

আরো

সম্পর্কিত খবর