Friday 03 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারে সক্রিয় সংঘবদ্ধ চক্র

মো. ইসহাক, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৩ অক্টোবর ২০২৫ ২২:৫৯

হরিণের চামড়া। ছবি: সংগৃহীত

বান্দরবান: বান্দরবানের অন্যতম পর্যটন স্পট প্রান্তিকলেক ও কদুখোলা এলাকায় খাস পতিত পাহাড়, সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বান্দরবান সীমায় লাগোয়া চট্টগ্রামের বনবিভাগের রিজার্ভ ফরেস্টে বিশেষ জাল ও নানা ফাঁদ পেতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বন্যপ্রাণী শিকার এবং জীবিত ধরে পাচারের অভিযোগ উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে।

এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে রাতের আধাঁরে অবাধে সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বনবিভাগের রিজার্ভ ফরেস্টের বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ কেটে পাচার করে যাচ্ছে। ফলে উক্ত এলাকায় মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে। এছাড়াও শিকারের কারণে এসব পাহাড় ও বনাঞ্চল থেকে নানা প্রজাতির পশুপাখি হারিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি এলাকাবাসীর।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়দের অভিযোগ প্রায় ১০ বছর যাবত চক্রটির কয়েকজন সদস্য প্রান্তিকলেক এলাকাস্থ সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পতিত খাস পাহাড়ের প্রায় ২০ একরের অধিক জায়গায় সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ পরিবেশের ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ লাগিয়ে ভূমি দখল করে নিয়েছে। স্থাপন করেছে ঘরবাড়িও।

স্থানীয়রা বলেন, এসব ক্ষতিকর গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তাদের কৌশল হলো গাছগুলো বড় হয়ে গেলে প্রশাসন ও লোকজনকে বুঝাতে সক্ষম হবে তারা জায়গাগুলোতে দীর্ঘ বছর ধরে ভোগদখলে আছেন এবং বসবাস করে আসছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন অনুযায়ী কোনো পাহাড় বা ভূমিতে যদি কেউ দীর্ঘ দিন বা বছর ভোগদখলে থাকে, তবে এসব পাহাড়, ভূমি খাস হলেও বসবাসকারী সেখানে থাকতে এবং চাষাবাদ করতে পারবে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চেষ্টা করছে চক্রটি। বসতি স্থাপন ও বসবাসের সুযোগ নিয়ে এরা বন্যপ্রাণী শিকার, গাছ পাচারসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে।

স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙ্গালী লোকজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত শনিবার সরেজমিনে সুয়ালক ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড কদুখোলা ও প্রান্তিকলেকসহ আশপাশে এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, পতিত খাস পাহাড়, বনভূমি, বনাঞ্চল ও কালাইচ্ছাখোলা সীমা লাগোয়া চট্টগ্রামের বনবিভাগের রিজার্ভ ফরেস্ট এরিয়ার কাছাকাছি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে একাধিক অবৈধ বাড়ি গড়ে উঠেছে। বাড়ির চারপাশে রয়েছে নিষিদ্ধ ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি ছোটবড় গাছ এবং চারাগাছের একাধিক বাগান। বাড়ির উঠানে হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল দেখা গেলেও বসতঘরগুলো ছিল লোকশূন্য।

স্থানীয়রা জানান, সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা এসব খাস জায়গায় দখল করে ঘরবাড়ি তৈরি করেছে ও পরিবেশে ক্ষতিকর গাছের বাগানগুলো করেছেন। আপনাদের (সাংবাদিকদের) উপস্থিতি টের পেয়ে ঘরের লোকজন পাহাড়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিগত ৫ থেকে ১০বছর আগেও বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের প্রান্তিকলেক, হলোদিয়া, কদুখোলা, ঢাইক্কাখোলা, ভাগ্যকূল, রোয়াইজ্জাখোলা, কালাইচ্ছাখোলায় শত শত খাস পাহাড়, বনভূমি ও এই এলাকা সংলগ্ন চট্টগ্রাম বনবিভাগের রিজার্ভ ফরেস্ট ও পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এরিয়াজুড়ে ভরপুর গাছ-পালা ছিল। বনাঞ্চলে অভয়ারণ্য ছিল পশুপাখি ও নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই সংঘবদ্ধ চক্র দিনেদুপুরে ও রাতের আধাঁরে রিজার্ভ ফরেস্টের বনাঞ্চল থেকে অবাধে কাঠ এবং বন্যপ্রাণী নিধন ও পাচার করে আসছে। এতে বনাঞ্চল উজাড়সহ বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাসস্থল ধ্বংসের মুখে পড়েছে।

বনবিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় এসব বনাঞ্চলে ময়না, হিল ময়না, টিয়া, রাজধনেশ, দোয়াল, মুতুরা, ঘুঘু, বনপায়রা, সাদাবক, কাক, কোকিল, শালিক, হরিয়াল, চড়ুই, কুড়াডগ, বনহাঁস, বাজপাখি, কোয়েল, চিল, পেঁচা, মাছরাঙা পাখি, ঈগল, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, কাঠশালিক, বউকথাকও, পাতিহাঁস, বাবুইসহ প্রায় ৩৫-৪০ প্রজাতির পাখি এবং সাম্বার হরিণ, মায়া হরিণ, গয়াল, বুনো গরু, বন ছাগল, বনরুই, গন্ধগোকুল, বেজি, তক্ষক, ভোঁদড়, চিতাবিড়াল, লজ্জাবতী বানর, মেঘলা চিতা, মার্বেল চিতা, কালো ভালুক, উলু বানর, উল্লুক, লম্বা লেজি শজারু, হলুদ কচ্ছপ, মথুরা, বন মোরগ, বানর, লজ্জাবর্তী বানর, সজারো, বনশূকর, নেকড়ে বাঘ, বনশিয়াল, বনকুকুর (রাম কুকুর), কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল, অজগর, লালপান্ডা, ২১ প্রজাতির ইঁদুরসহ বিভিন্ন সরীসৃপ প্রাণী দেখা যেত। কিন্তু এই সংঘবদ্ধ চক্র অবাধে শিকার ও পাচারের কারণে এসব বন্য প্রাণীকূল এখন বিলুপ্তির পথে।

কদুখোলার বাসিন্দা মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘চক্রটির সদস্যদের নাম বলবো না, বললে আমার সমস্যা হবে। এরা প্রায় সময় জাল, ফাঁদ পেতে বনমোরগ, সাম্বার হরিণ, মায়া হরিণ, বুনোগয়াল, বুনোগরু, বুনোছাগল শিকার করে গ্রামেই কেটে মাংস বিক্রি করে। একটি বনমোরগ ২-৩ হাজার টাকা, হরিণ, বুনোগরু, গয়াল, বুনো ছাগলের মাংস প্রতিকেজি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করে।

প্রান্তিকলেক এলাকার মুরুং পাড়ার বাসিন্দা রেংনিং ম্রো বলেন, এই এলাকায় ১২-১৩ জনের সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। চক্রের মূলহোতা সৈয়দ আলম, আব্দুল আলম ও শফিকুর ইসলাম। এরা বিগত ৮-১০বছর যাবত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও সরকারি বনাঞ্চল, পাহাড়, বনভূমি, বনবিভাগের বাগানের গাছ, কাঠ কেটে পাচারের অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে।

ঢাইক্কাখোলার কৃষক আব্দুল জালাল বলেন, পাখি ও বন্যপ্রাণী শিকার করার জন্য চক্রটির কাছে দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন অস্ত্র ও জীবিত ধরার জাল, নানারকম ফাঁদপাতার যন্ত্র রয়েছে। এরা খুবই হিংস্র প্রকৃতির লোক। স্থানীয়দের সঙ্গে প্রায় সময় ঝগড়া-বিবাদ, মারামারিসহ নানা অপকর্মে জড়ায়। স্থানীয়রা এদের ভয় পায়। তাই সহজে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায় না।

কদুখোলার বাসিন্দা ছলিম উল্লাহ বলেন, চক্রটির অধিকাংশ সদস্য মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে এই এলাকার মানুষের বাগান, চাষাবাদ জমি ও পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে এরা স্থানীয়দের সঙ্গে ছেলেমেয়ের বিয়েসাদী করিয়ে আত্মীয়তার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে শক্তি অর্জন করেছে। অর্থের বিনিময়ে এবং নানা কৌশলে জাল কাগজ তৈরি করে বাংলাদেশের নাগরিকও হয়ে গেছে এরা।

এব্যাপারে বান্দরবান বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, বর্তমানে বন্যহাতি সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। তবে পাখিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যা, পাচার রোধ ও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে বনবিভাগ।

সারাবাংলা/জিজি

বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার সংঘবদ্ধ চক্র

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর