Sunday 05 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রাম্পের শুল্কের প্রভাব
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পোশাক রফতানি কমেছে

এমদাদুল হক তুহিন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৫ অক্টোবর ২০২৫ ২২:৩৭

বাংলাদেশের পোশাক কারখানা। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রের পালটা শুল্কের প্রভাবে দেশের পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর দুই মাসেই ধারবাহিকভাবে কমেছে দেশের পোশাক রফতানি আয়। আগস্টে পোশাক খাতে রফতানি আয় ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ কমেছে। আর এই রফতানি আয় কমার পেছেনে যুক্তরাষ্ট্রের পালটা শুল্ককে দায়ী করছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।

তাদের মতে, শুল্কের ভার ক্রেতার ওপর পড়ায় তারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে কমেছে দেশের পোশাক রফতানি। এছাড়া, ‘শুল্ক অনিশ্চিয়তায়’ আগাম পণ্য কিনে নেওয়ায় আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ক্রয়াদেশ কম ছিল। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের প্রকৃত প্রভাব দেশের পোশাক রফতানি আয়ে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা।

বিজ্ঞাপন

রোববার (৫ অক্টোবর) রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সদ্যবিদায়ী সেপ্টেম্বরে পোশাক রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০২৪ সালে সেপ্টেম্বরে যেখানে পোশাক রফতানি ছিল ৩ হাজার ১০ মিলিয়ন ডলার, ২০২৫ সালের একই সময়ে তা কমে ২ হাজার ৮৩৯ ডলারে নেমে এসেছে।

ইপিবির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তবে পরের দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট মাসে পোশাক রফতানি কমেছে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। মাস হিসেবে জুলাইয়ে রফতানি হয়েছিল ৩ হাজার ৯৬২ মিলিয়ন ডলার, আগস্টে ৩ হাজার ১৬৮ মিলিয়ন ডলার ও সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৮৩৯ মিলিয় ডলার।

এদিন প্রকাশিত ইপিবির তথ্য থেকে জানা যায়, নিটওয়্যার ও ওভেন দুই খাতেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে বিদায়ী সেপ্টেম্বরে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে নিটওয়্যার পোশাক রফতানি যেখানে ১ হাজার ৭২৯ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৩০ মিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে নিটওয়্যার পোশাক রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর ওভেন রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওভেন পোশাক রফতানি যেখানে ১ হাজার ২৮০ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০৯ মিলিয়ন ডলারে।

জানতে চাইলে দেশের পোশাক মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতনিকারক সমিতির (বিজিএমইএ)’ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ট্যারিফের কারণেই আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য ট্যারিফ কত হবে তা জানা ছিল না। তাই বায়ারার (ক্রেতারা) বাড়তি শুল্কের বোঝা এড়াতে অতিরিক্ত পণ্য কিনে নিয়েছে। জুলাইয়ে বায়ারারা বেশি পোশাক কিনেছে। ফলে জুলাইয়ের রফতানি আয়ে বেশ ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।’

তিনি জানান, সেপ্টেম্বর লিন পিরিয়ড (পোশাকের চাহিদা কম)। এখন দেখার বিষয়, অতিরিক্ত শুল্কের বিষয়টি সাধারণ ক্রেতার (ভোক্তা) কীভাবে নেয়; তার ওপর নির্ভর করবে পোশাক রফতানির গতিপথ। অক্টোবর-নভেম্বরে কিছুটা বোঝা যাবে ক্রেতারা কী ধরণের আচরণ করছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের প্রভাবেই পোশাক রফাতনিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানি করে থাকে স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিটি ক্রেতার (বায়ার) একটি বাজেট থাকে। যারা আমদানিকারক, আমাদের অর্ডার দেয়; তাদের একটি বাজেট থাকে। ২০ শতাংশ যে অতিরিক্ত ট্যারিফ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, এই টাকা তো বায়ারদের-ই পরিশোধ করতে হবে। টাকাটা তারা কোথা থেকে দেবে। তাদের একটিই উপায়, হয় পোশাকের দাম বাড়াতে হবে, যেটি হুট করে আমেরিকায় বাড়ানো সম্ভব নয়; নতুনবা নতুন পোশাক কম কিনবে। তারা এখন কম পোশাক কিনছে। এটিই মূল কারণ।’

তিনি বলেন, ‘ট্যারিফের ব্যয়টি তারা কাপড় কম কিনে মেটানোর চেষ্টা করছে। তারা অর্ডার কম দিচ্ছে ও পোশাক কম কিনছে। জুলাইয়ের শেষ দিকে আমাদের জন্য ট্যারিফ চূড়ান্ত হলো। তার আগেও তো ক্রেতারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না বাংলাদেশের জন্য ট্যারিফ কত হবে, কী হবে! তারা তাদের অর্ডার খুব সচেতনভাবে অন্য দেশে শিফট করেছিল। এ কারণেই অর্ডার কম এসেছিল। ফলে গত দুই মাস পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে।’

এ বিষয়ে দেশের নিটওয়্যার পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘পোশাক রফতানি কম হওয়ার কারণে দেশের সামগ্রিক রফতানি আয়েও প্রতিফলিত হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। কারণ, বেশিরভাগ ক্রেতাই নতুন করে কোনো অর্ডার দিচ্ছে না। তারা এখন অতিরিক্ত ২০ শতাংশ পালটা শুল্কের একটি অংশ বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রফতানিকারকদের পক্ষে এই অতিরিক্ত চাপ বহন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এছাড়া, বাংলাদেশের রফতানিকারকরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্যান্য বাজারেও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। কারণ, চীনা ও ভারতীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এইসব বাজারে রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।’

জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সারাবংলাকে বলেন, ‘রফতানি কমার পেছেনে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রভাব রয়েছে। ট্যারিফের পুরো বিষয়টি এখনও সেটেলমেন্ট হয়নি। শুল্কের পুরো বিষয়টি সমাধান হলে আমরা যে সুযোগ-সুবিধা পাব, তা হয়তো সামনের দিন থেকে স্পষ্ট হবে।’ আর এসময়ে পোশাকের অর্ডার এমনিতেও একটু কম থাকে। সব মিলিয়েই দেশের পোশাক রফতানি আয় কমেছে বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রাম্পের শুল্ক নিয়ে দোদুল্যমানতার কারণে অনেক ক্রেতা আগাম পণ্য কিনে নিয়েছে। ফলে জুলাইয়ের পোশাক রফতানিতে বড় প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। আর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের ক্রয়াদেশ তো আরও কয়েক মাস আগেই দেওয়া। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ওই শুল্কের প্রকৃত প্রভাব কী হতে যাচ্ছে তা বুঝতে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। তবে রফতানি কমার পেছনে যে ট্রাম্পের শুল্ক ভূমিকা রেখেছে তা স্পষ্ট। এটি একটি বড় কারণও।’

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই দেশের পোশাক রফতানির সবচেয় বড় গন্তব্য। দেশটিতে বাংলাদেশের পোশাকের ২০ শতাংশ রফতানি হয়ে থাকে। গেল এপ্রিলে ট্রাম্পের পালটা শুল্ক আরোপের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ স্থগিত করে। পরে পালটা শুল্কারোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হলে ক্রয়াদেশের স্থগিতাদেশও উঠে যায়। এর পর জুলাইয়ে ট্রাম্প শুল্কের বিষয়টি আবার সামনে নিয়ে এলে নতুন করে ক্রয়াদেশ স্থগিত হতে থাকে। তবে বাণিজ্য নিয়ে দর কষাকষি শেষে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্র।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

কমেছে ট্রাম্প পোশাক রফতানি যুক্তরাষ্ট্র শুল্কারোপ

বিজ্ঞাপন

আরো

এমদাদুল হক তুহিন - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর