ঢাকা: ’২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর বর্তমান রাজনীতির দুই প্রধান শক্তি বিএনপি ও জামায়াত— উভয়ই মিত্র হিসেবে পাশে চেয়েছিল কয়েকটি ইসলামিক দলকে। তবে শেষ পর্যন্ত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতকে নিয়ে একটি ‘ইসলামি অ্যালায়েন্স’ হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এই অ্যালায়েন্সের নেতৃত্বে থাকবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিসের মতো বড় ইসলামিক দলগুলো।
এদিকে সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ‘ইসলামিক শক্তির’ পক্ষে একটি ‘জোয়ার’ সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা ইসলামপন্থী দলগুলোর। আর তারা সেই ‘জোয়ার’ ধরে রাখতে বিভিন্ন পথ ও পন্থায় এগোচ্ছে। এরকমই একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ ও পন্থা হলো- একক বাক্সে ভোট। তাই পুরোনো বিভেদ ভুলে দলগুলো আসন্ন নির্বাচনে ‘ইসলামিক শক্তির’ পক্ষে বিশেষ জনমত গড়তে চায়। তাদের টার্গেট— ভোটগুলো একক বাক্সে নেওয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসলামিক দলগুলার জোট গঠনের প্রাথমিক আলোচনা গত বছরের ৫ আগস্টের পর পরই শুরু হয়। কিন্তু ওই বছরের শেষ ছয় মাসে অগ্রগতি খুব একটা ছিল না। কিন্তু, চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি বরিশালে চরমোনাই পীরের দরবারে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। এমনকি তিনি চরমোনাই পীরের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজেও অংশ নেন। সেই বৈঠকের পর থেকেই রাজনীতিতে আলোচনায় আসে ‘ইসলামী দলের ঐক্য’।
দীর্ঘদিন ঘরোয়া আলোচনা ও সিরিজ বৈঠকের পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনসহ নানান দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি রাজনৈতিক দল বিক্ষোভ করে। এর আগে ওই সাতটি দল পৃথক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিন দিনের অভিন্ন কর্মসূচিও ঘোষণা করে। দলগুলো হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাগপা।
এই দলগুলোর দাবির মধ্যে ছিল- জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন, পিআর পদ্ধতি চালু, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা ও স্বৈরাচারী শক্তির দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একদিনে ইসলামিক দলগুলোর অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা নিছক কাকতালীয় নয়, বরং এখানে কৌশলগত সমন্বয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মূলত যুগপৎ এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যে, ইসলামিক দলগুলোর একটি অ্যালায়েন্স খুব দ্রুতই হতে যাচ্ছে। আবার অনেকে এটিকে ইসলামিক ভোটব্যাংক সক্রিয় করার একধরনের ‘ট্রায়াল রান’ বা ‘মহড়া’ হিসেবেও দেখছেন।
এদিকে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য ঠেকাতে ষড়যন্ত্র চলছে বলে জানিয়েছেন নেতারা। তাদের অভিযোগ, বিপক্ষ শক্তি ইসলামী দলগুলোকে বিভিন্ন ধরণের প্রলোভন দেখাচ্ছে। তবে এবার তাদের সেই প্রলোভনে কেউ পা দেবে না। আগামী নির্বাচনে ইসলামিক দলগুলোর ভোটের বাক্স একটি হবে।
এ বিষয়ে ২১ জানুয়ারি চরমোনাই দরবারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশিদের মর্যাদা নেই।’ কারণ হিসেবে তিনি দেশের দুর্নীতি ও দুঃশাসনকে দায়ী করেন। ইসলামী দল হিসেবে আলাদা হলেও নিজেদের মধ্যে দূরত্ব না থাকার কথাও জানান জামায়াতের আমির।
তিনি বলেন, ‘চিন্তার ব্যবধান থাকতেই পারে, তবে মানুষের কল্যাণে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে একযোগে কাজ করবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।’ আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে এক বাক্সে ভোট পড়বে বলেও আশা করেন তিনি।
এ সময় চরমোনাই পীর বলেন, ‘গত ৫৩ বছরে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইসলামের পক্ষে কাজ করার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা ইসলামী দলগুলো কাজে লাগাতে না পারলে মানুষের অকল্যাণ হবে। একযোগে কাজ করতে পারলে আগামীতে ইসলামী দলের জোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবে।’
বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে অগণিত ইসলামিক দল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি দলের নিবন্ধন আছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে এসব ইসলামিক দল বিভিন্ন বড় দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য দলগুলো সংসদে যেতে পারেনি। অনেকে মনে করেন, নিজেদের মধ্যে নানা মতবিরোধের কারণেই এদেশে ইসলামিক দলগুলো ভোটের মাঠে সফলতা পায়নি। সেই হিসেবে ৫ আগস্ট পরবর্তী নতুন রাজনীতিতে ইসলামিক দলগুলো যদি এক হতে পারে তাহলে তাদের সফল হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
সুত্র জানায়, এবারের নির্বাচনে জোট করে এক বাক্স দেওয়ার জন্য ইসলামিক দলগুলোর তৃণমূল থেকে যেমন দাবি আছে, তেমনি জামায়াতে ইসলামীর মতো বড় রাজনৈতিক দলও এবার ছাড় দিয়ে হলেও একটি বাক্স দিতে চায়। দলের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, জামায়াত জোট গঠনের জন্য এবার শতাধিক আসন জোটের দলগুলোর জন্য ছেড়ে দিতে রাজি আছে।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তরের প্রচার (মিডিয়া) সম্পাদক মু. আতাউর রহমান সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘৫ আগস্টের বিপ্লবের পর পরিবর্তন ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান উঠেছে। এ ক্ষেত্রে এদেশের ইসলামিক ও দেশপ্রেমিক দলগুলোর প্রতি আপামর জনগণের প্রত্যাশা বেড়েছে। সেই প্রত্যাশা পূরণে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জরুরি। জামায়াতে ইসলামী সেক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। আশা করি আগামী নির্বাচনে ইসলামিক দলগুলোর পক্ষ থেকে একটি ভোটের বাক্স দেওয়া হবে।’
একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব এবং অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মীর ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন কোন জোটে যাবে সে বিষয়ে এখনো দলীয়ভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বৈঠক করে শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
নতুন জোট সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যুগপৎভাবে কর্মসূচি দিয়েছি। এখনো কোনো জোট হয়নি। আর ভোট একবাক্স হবে কি না তা বলার সময় এখনো আসেনি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বলা যাবে কোন দল কোন জোটে যাবে।’