২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। হামাসের হামলার পর গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরু। ওই সময় গাজার প্রায় সব মানুষই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটি হবে নির্মম যুদ্ধ। তবে কেউ ভাবেনি যে, এটি দুই বছর ধরে চলবে; কেউ ভাবেনি যে, বিশ্ব এত দীর্ঘ সময় ধরে এই ঘটনা ঘটতে দেবে। যদিও দুই বছরের বিধ্বংসী যুদ্ধের পর এখন এর সমাপ্তি টানার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি একটি সম্ভাবনা। কিন্তু হামাস-ইসরায়েল এই সুযোগকে কাজে লাগাবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) বিবিসির এক বিশেষ প্রতিবেদন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো।
এই আলোচনাটি এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার ঠিক দুই বছর পূর্ণ হলো। এই হামলা একদিকে ইসরায়েলিদের ওপর এক তীব্র মানসিক আঘাত সৃষ্টি করেছিল। এই হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত হন, এদের বেশিরভাগই ছিলেন ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক। সেইসঙ্গে ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। ইসরায়েলিদের অনুমান, এখসো ২০ জন জিম্মি জীবিত আছেন এবং তারা আরও ২৮ জনের মৃতদেহ ফেরত চান।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক সামরিক অভিযানে গাজার বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের হামলায় ৬৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। এর মধ্যে ১৮ হাজারের বেশি শিশু। এই পরিসংখ্যানগুলো হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, যা সাধারণত নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত। লন্ডনের চিকিৎসা সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’-এর একটি গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, এই সংখ্যাটি প্রকৃতপক্ষে কম হতে পারে।
যুদ্ধ সমাপ্তির আকাঙ্ক্ষা
ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয় পক্ষই চায় যুদ্ধ শেষ হোক। ইসরায়েলিরা এখন যুদ্ধ-ক্লান্ত। এক জনমত জরিপে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জিম্মিদের ফেরত আনা ও যুদ্ধ শেষ করার পক্ষে একটি চুক্তি সমর্থন করে। সশস্ত্র বাহিনীর (আইডিএফ) কয়েক লাখ রিজার্ভ সেনা মাসখানেক সক্রিয় দায়িত্ব পালনের পর তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান।
গাজার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন। তারা একদিকে আডিএফ’র গোলাগুলির শিকার। অন্যদিকে অনাহার এবং ইসরায়েলের ত্রাণ প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধের কারণে সৃষ্ট মানুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের শিকার। দুই বছর আগে ইসরায়েলে বিধ্বংসী হামলা চালানোর মতো যে সুসংগঠিত সামরিক শক্তি হামাসের ছিল; তা এখন ভেঙে গেছে। এটি এখন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আইডিএফ’র বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালানো একটি শহুরে বিদ্রোহী শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
হামাস ও নেতানিয়াহুর কৌশলগত অবস্থান
হামাস ক্ষমতা ছেড়ে ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাটদের হাতে তুলে দিতে রাজি হলেও তারা টিকে থাকার পথ খুঁজছে। তারা স্বীকার করে, তাদের ভারী অস্ত্রের অবশিষ্টাংশ হস্তান্তর বা ভেঙে দিতে হবে। তবে, তারা চায় কিছু অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখতে, যাতে প্রায় দুই দশকের নৃশংস শাসন এবং বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য প্রতিশোধ নিতে চাওয়া ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। প্রকাশ্যে না বললেও, হামাস একটি ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে তার লক্ষ্য পূরণের ক্ষমতা ভবিষ্যতে পুনরুদ্ধার করতে চায়।
ইসরায়েল যদিও হামাসের আত্মসমর্পণ নির্দেশ করতে চায়, কিন্তু আলোচনার টেবিলে আসার এই সুযোগ হামাসের জন্য এক মাস আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, এক মাস আগে দোহায় হামাস নেতৃত্বের ওপর ইসরায়েলের হামলা ব্যর্থ হয়েছিল। সেই হামলার মূল লক্ষ্য, সিনিয়র নেতা খলিল আল-হায়া, এখন শার্ম এল-শেখ-এ আলোচনায় হামাসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ভিন্নধরনের টিকে থাকার কথা ভাবছেন। তিনি তার ক্ষমতা ধরে রাখতে, দুর্নীতির বিচার স্থগিত রাখতে, আগামী বছরের নির্বাচন জিততে এবং নাৎসি হলোকাস্টের পর ইহুদিদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দিনের নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য দায়ী নেতা হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হওয়া এড়াতে চান। এ জন্য তিনি বারবার ব্যবহৃত শব্দবন্ধ ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ ঘোষণা করার মতো একটি বিশ্বাসযোগ্য উপায় খুঁজছেন। তিনি এর সংজ্ঞা দিয়েছেন, জিম্মিদের মুক্তি, হামাসের ধ্বংস এবং গাজার অসামরিকীকরণ।
আলোচনার কাঠামো এবং মধ্যস্থতাকারীরা
হামাস এবং ইসরায়েলি আলোচকরা সরাসরি মুখোমুখি হবেন না। মিশরীয় ও কাতারের কর্মকর্তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছেন, এবং আলোচনায় উপস্থিত আমেরিকানরা একটি বড়, সম্ভবত সিদ্ধান্তকারী প্রভাব ফেলবেন। আলোচনার ভিত্তি হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০-দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা, ট্রাম্পের ‘স্থায়ী শান্তি’র দাবি সত্ত্বেও জর্ডান নদী এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের এবং ইসরায়েলিদের দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসান ঘটাবে না। এতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত পশ্চিম তীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই।
শার্ম এল-শেখ-এ ঝুঁকি অনেক বেশি। আরব ও ইহুদিদের মধ্যে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতের মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে যুদ্ধবিরতির সুযোগ রয়েছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো- ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলি জেলে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিনা বিচারে আটক গাজাবাসীদের মুক্তি দেওয়ার শর্তগুলো ঠিক করা।
ট্রাম্পের প্রভাব ও নেতানিয়াহুর ওপর চাপ
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্রুত ফল চান। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে একটি ‘গ্র্যান্ড বার্গেন’ চুক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুনরুজ্জীবিত করতে চান। ইসরায়েল গাজায় বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা এবং মানবিক সহায়তায় বিধিনিষেধের কারণে সৌদি আরব এই মুহূর্তে এমন কোনো চুক্তিতে যাবে না। সৌদিরা একাধিকবার স্পষ্ট করেছে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি স্পষ্ট ও অপরিবর্তনীয় পথ ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে এমন একটি নথিতে সই করতে বাধ্য করেছেন যাতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সম্ভাবনা নিয়ে একটি অস্পষ্ট উল্লেখ ছিল। যদিও নেতানিয়াহু পরে সেই উল্লেখকে উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনিরা কখনই রাষ্ট্র পাবে না বলে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
একটি প্রশ্ন হলো, হামাস কেন ইসরায়েলের গাজা ত্যাগ এবং যুদ্ধ শেষ করার কঠোর সময়সূচি ছাড়াই জিম্মিদের ছেড়ে দিতে প্রস্তুত? একটি সম্ভাবনা হলো, কাতারিরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, ট্রাম্পকে সব জিম্মি ফিরিয়ে দিয়ে বিজয়ের দাবি করার সুযোগ দিলে তিনি নিশ্চিত করবেন যেন যুদ্ধ শেষ হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ‘হামাস আন্তরিক কি না তা জানতে মাত্র কয়েকদিন লাগবে। কিন্তু একটি জটিল চুক্তির খুঁটিনাটি তৈরি করতে আরও বেশি সময় লাগবে।’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি কখনও ইসরায়েলের ওপর আমেরিকার নির্ভরশীলতার সুযোগ নেননি। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি প্রয়োগ করে ইসরায়েলের ওপর আমেরিকার ক্ষমতা ব্যবহার করে নেতানিয়াহুকে আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য করেছেন।
আলোচনা ব্যর্থ হলে ঝুঁকি
হামাস ও ইসরায়েল উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদলেরই নিজ নিজ দেশে শক্তিশালী সমালোচক আছেন, যারা চান যুদ্ধ চলুক। হামাসের সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, গাজায় থাকা সামরিক কমান্ডাররা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে এবং যত বেশি সম্ভব ইসরায়েলিকে সঙ্গে নিয়ে মরতে প্রস্তুত। অন্যদিকে, নেতানিয়াহুর জোট উগ্র জাতীয়তাবাদী চরমপন্থীদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল, যারা গাজার ফিলিস্তিনিদের বের করে দিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন করার স্বপ্নের কাছাকাছি ছিল।
যদি মিশরের এই আলোচনা ব্যর্থ হয়, তবে উভয়পক্ষের চূড়ান্ত পরিণতির আশঙ্কা তৈরি হবে।