চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে রাস্তায় প্রাইভেটকারে গুলি করে খুন করা ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম বিএনপি’র ‘কেউ নন’ বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনীতি বা বিএনপি’র কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।
দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বুধবার (৮ অক্টোবর) বিএনপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে রিজভী এসব কথা বলেন।
এদিকে নিহত ব্যবসায়ী হাকিম দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও ‘বিএনপি সমর্থক’ হিসেবে দাবি করেছেন রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। হাকিম তার ঘনিষ্টজন বলে এলাকায় পরিচিত।
হত্যাকাণ্ডের পর গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী সারাবাংলা-কে জানান, আব্দুল হাকিম বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না, তবে সমর্থক ছিলেন।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চট্টগ্রামের রাউজান সীমান্তবর্তী হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট এলাকায় চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে প্রাইভেটকারে গুলি চালিয়ে মো. আব্দুল হাকিম (৬০)-কে খুন করা হয়। তার বাড়ি রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের পাচখাইন গ্রামে। নিজ বাড়িতে ‘হামিম এগ্রো’ নামে একটি গরুর খামার পরিচালনা করতেন তিনি।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কারে চড়ে আব্দুল হাকিম চট্টগ্রাম নগরীর দিকে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার সংযোগস্থল মদুনাঘাট সেতু পার হওয়ার পর তিনটি মোটর সাইকেলে করে হেলমেট পরা তিনজন এসে গাড়ির সামনে বসা তাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। এতে গাড়ির সামনের কাচ ফুটো হয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় গাড়ির ভেতর লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে দ্রুত নগরীর অনন্যা আবাসিক এলাকায় বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির দুই কেন্দ্রীয় নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘাতে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা। গত এক বছরে বিএনপির সাতজন নেতাকর্মীসহ অন্তঃত এক ডজন খুনের ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই রাউজানে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার। এ ঘটনার পর গিয়াস কাদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির পদ হারান। গোলাম আকবরের নেতৃত্বাধীন উত্তর জেলার আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।
ধারাবাহিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে প্রকাশ্যে সড়কে ফিল্মি স্টাইলে আব্দুল হাকিমকে খুনের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তাকে বিএনপির নেতা বা কর্মী হিসেবে উল্লেখ করে বিভিন্ন প্রচারণা চলছে।
এ প্রেক্ষিতে সমালোচনার মুখে পড়া বিএনপি’র পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলীয় অবস্থান পরিস্কার করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কয়েকটি গণমাধ্যমে নিহত ব্যক্তিকে (আব্দুল হাকিম) বিএনপির কর্মী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। নিহত ব্যক্তি ও দুষ্কৃতিকারীদের কেউই বিএনপির নেতাকর্মী নন। এ সহিংস ঘটনা সম্পূর্ণরূপে সমাজবিরোধী কিছু দূর্বৃত্তচক্রের পরিকল্পিত হিংস্র কর্মকাণ্ড। এর সাথে রাজনীতি বা বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।’
এ ঘটনাকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির একটি বড় নজির উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই রক্তাক্ত ঘটনা ওই এলাকার জনমনে উদ্বেগ ও ভীতির সঞ্চার করেছে।
‘বর্তমানে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, চারদিকে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও হতাশা, এ সরকারের কাছ থেকে জনগণ প্রত্যাশা করে না। জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে দুষ্কৃতিকারীরা অপকর্মে মেতে উঠেছে। সমাজের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসন নিষ্ক্রিয়। এখন পর্যন্ত দেশের কোথাও কোন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়নি। জনগণ এ অরাজক পরিস্থিতির দ্রুত অবসান দেখতে চায়।’
বিএনপি ‘রাউজানের’ সন্ত্রাসী ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে এলাকায় আধিপত্যকামী দুষ্কৃতিকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে।
তবে বিএনপি আব্দুল হাকিমকে তাদের কর্মী নন বলে দাবি করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দলটিতে তার সদস্যপদ নবায়নের একটি রশিদ ছড়িয়ে পড়েছে।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, আব্দুল হাকিম একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এরপর তিনি রাউজানের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি পান। আওয়ামী লীগের পতনের পর গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যিনি ফজলে করিমের চাচাতো ভাই, এলাকায় ফিরলে হাকিম তার সঙ্গে যোগ দেন।