আফ্রিকা মহাদেশের ছোট্ট একটি দেশ ইসোয়াতিনি (পূর্বতন সোয়াজিল্যান্ড)। এই ছোট দেশটির বর্তমান রাজা তৃতীয় এমসোয়াতি। দেশটি আকারে ছোট হলেও রাজার পরিবার একেবারেই ছোট নয়। আফ্রিকার এই ছোট দেশটির নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান খুবই সাদামাঠা। অর্থনৈতিকভাবেও দেশটির বেহাল দশা। এতো কিছু হলে কী হবে, দেশের রাজা কাটান বিলাসী জীবন।
রাজার মোট ৩০ জন স্ত্রী, সবমিলিয়ে সন্তানের সংখ্যা ৩০-৩৫। গৃহকর্ম সহায়কের সংখ্যা গুনে গুনে একশো। পুরো পরিবার ও পরিচারকদের নিয়ে আবুধাবিতে এসেছিলেন আফ্রিকার নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের সদস্য এমসোয়াতি। চলতি বছরের ১০ জুলাই ব্যক্তিগত বিমানে করে রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যেরা হাজির হন সংযুক্ত আরব আমিরতের আবুধাবি বিমানবন্দরে। সেই পুরনো ভিডিও নিয়ে নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ব্যক্তিগত জেট থেকে নামছেন একজন পুরুষ। পোশাকটি দিয়ে শুধুমাত্র রাজার শরীরের নিম্নাংশ ঢাকা। তার পেছনে সুসজ্জিত ও আধুনিক পোশাক পরা কয়েকজন রমণী। ভিডিওটি প্রথমে সকলের নজর কেড়েছিল বেশ কয়েকটি কারণে। নেটিজেনদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল কেন হঠাৎ করে অর্ধেক পোশাক পরা ব্যক্তিটিকে তার আশপাশের লোকেরা মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ জানিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন ও সালাম ঠুকছেন। স্বাভাবিকভাবেই সকলের কৌতূহলী প্রশ্ন ছিল, কে এই ব্যক্তি? অর্ধেক পোশাক পরে কেন তিনি এতো বিলাসবহুল ভ্রমণ করছেন? তার সঙ্গে থাকা নারীরাই বা কারা?
জানা যায়, তিনি রাজা এমসোয়াতি। তার সঙ্গে ছিলেন রাজপুত্র-কন্যারাও। রাজপরিবারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ১০০ জন পরিচারকও ছিল। বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক আলোচনার জন্য আবুধাবিতে এলেও রাজার বিলাসী জীবন নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও সংবাদমাধ্যমে। সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজা ও তার বিরাট সংসার নিয়ে হঠাৎ করে চলে আসার ফলে আবুধাবি বিমানবন্দরের কাজকর্ম কিছু সময়ের জন্য লাটে ওঠে।
রাজার এই আগমন এতোটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দেখভালকারীরা তিনটি টার্মিনাল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অস্থায়ী লকডাউনও জারি করা হয় সেখানে। রাজা এমসোয়াতিকে চিতাবাঘের ছাপের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা অবস্থায় দেখা যায় সেই ভিডিওতে। রানিরা ধরা দিয়েছেন উজ্জ্বল, রঙিন পোশাকে। রাজার ১০০ জন পরিচারকের দল রাজকীয় জিনিসপত্র এবং রসদ ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত ছিল।
জানা গেছে, দেশ গরিব হলেও রাজা এমসোয়াতির জীবন বৈচিত্রে ভরপুর। বিদেশে গেলে ব্যক্তিগত বিমান ছাড়া চলেন না। গ্যারাজে রয়েছে রোলস রয়েস থেকে শুরু করে একাধিক বিদেশি বিলাসবহুল গাড়ি। কয়েকশো কোটি টাকা দিয়ে স্ত্রীদের রোলস রয়েস কিনে দিয়েছেন রাজা, এমনটাই জানিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
তৃতীয় এমসোয়াতি ১৯৮৬ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ছোট্ট দেশটি শাসন করে আসছেন। একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, তার ব্যক্তিগত সম্পদ এক হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। নির্মাণ, পর্যটন, কৃষি, টেলিযোগাযোগের মতো বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারের মালিক রাজা নিজে। রাজার বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং দেশের নাগরিকদের দৈনন্দিন সংগ্রামের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত বলেও অভিযোগ।
রাজার সম্পত্তি ফুলেফেঁপে উঠলেও সে দেশের জনগণের অবস্থা শোচনীয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটির স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশা। সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ওষুধের ঘাটতি। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা অনুদানের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না করে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশ্ব ব্যাংক জানিয়েছে, ইসোয়াতিনিতে ২০২১ সালে বেকারত্ব ২৩% থেকে বেড়ে ৩৩.৩% হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের জাতীয় সম্পদ রাজপরিবারের কুক্ষিগত বলে জনগণের ৬০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন।
এই দেশের রাজাদের ঐতিহ্যবাহী একটি নামে ডাকা হয়, তা হলো ‘দ্য লায়ন’। তাদের পোশাকও রাজার পরিচয় বহন করে। বিয়ে করার জন্য স্ত্রী বাছাই করার পদ্ধতিটিও স্বতন্ত্র। প্রতি বছর আগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে সোয়াজি সম্প্রদায়ের হাজার হাজার কুমারী নারী এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। রাজা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন এবং তাদের প্রতি সম্মান জানান। এই সমস্ত তরুণীর মধ্যে থেকে একজনকে নিজের স্ত্রী হিসাবে বেছে নেন রাজা।
শতাংশের হিসাবে বিশ্বে এইচআইভি রোগীর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এই ইসোয়াতিনিতে। দেশের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশই রোগাক্রান্ত। ১০ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে এইচআইভি রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার জন। লিঙ্গবৈষম্য, বিভিন্ন অধিকার থেকে দেশবাসীকে বঞ্চিত করা খুব সাধারণ ব্যাপার দেশটিতে এমনটাই দাবি তুলেছেন সে দেশের অধিকাংশ মানুষ। দেশের অভ্যন্তরীণ অরাজকতা বিশ্বের দরবারে যাতে প্রকাশিত না হয় সে জন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে।