রংপুর: রংপুরের ৩ উপজেলা পীরগাছা, কাউনিয়া ও মিঠাপুকুরে অ্যানথ্রাক্সের ভয়াবহ কবলে পড়েছে। এতে স্থানীয় হাটবাজারে পশু ও মাংস বিক্রি একেবারেই কমে গেছে। একদিকে রোগ আতঙ্কে ক্রেতা ও পাইকাররা দূরে সরে যাচ্ছেন, অন্যদিকে দামের অবনতি দেখে খামারিরা পশু বিক্রি করতে চাচ্ছেন না। ফলে স্থানীয় কৃষক ও খামারিরা চরম অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। যদিও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। কারণ, টিকাদান কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয়েছে। তবুও গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ধাক্কা সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পীরগাছা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুই শতাধিক গবাদিপশু মারা গেছে। স্থানীয়দের মতে, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। রোগটি প্রথম পীরগাছার কয়েকটি গ্রামে দেখা দেয়, তারপর দ্রুত আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দেড় মাসের মধ্যেই কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলায়ও অ্যানথ্রাক্স হানা দেয়। যদিও এই দুই উপজেলায় পশু মৃত্যুর কোনো নথিভুক্ত ঘটনা ঘটেনি। তবে, মানুষের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক।
আইইডিসিআর’র (রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েছে যে, পীরগাছায় আটজন, মিঠাপুকুরে একজন এবং কাউনিয়ায় দু’জনের শরীরে এই জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সূত্রে জানা যায়, অর্ধশতাধিক মানুষ অ্যানথ্রাক্স উপসর্গে ভুগছেন, যাদের মধ্যে অনেকেরই নমুনা পরীক্ষাধীন। এছাড়া, মিঠাপুকুরে আরও ছয় জনের উপসর্গ দেখা গেছে, যাদের মধ্যে চার জনের অবস্থা উন্নত হয়েছে।
জুলাই-সেপ্টেম্বরে পীরগাছায় এই রোগের উপসর্গ নিয়ে দু’জন মারা গেছেন। চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলছেন, সময়মতো চিকিৎসা না নিলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। রোগটি গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়; বিশেষ করে অসুস্থ পশুর মাংস, রক্ত বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে। কিন্তু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।
এই আতঙ্কের মধ্যে স্থানীয় খামারিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পীরগাছার কেহেরমান গ্রামের খামারি টিপু সুলতান সারাবাংলাকে জানান, প্রথমে গরু, তারপর মানুষের মধ্যে রোগ শনাক্ত হওয়ায় সবাই মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তার খামারে ১২টি গরু, যার মধ্যে ৫টি বিক্রয়যোগ্য। কিন্তু ক্রেতা নেই, দামও কম। মাংস বিক্রেতারাও গরু জবাই করতে ভয় পাচ্ছেন।
টিপু সুলতানের কথায় যে হতাশা ও অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তা অনেক খামারির মনের কথা। চৌধুরানী এলাকার খামারি আশরাফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আতঙ্ক না কমলে ন্যায়সঙ্গত দামে গরু বিক্রি হবে না। বাইরে থেকে পাইকার আসছেন না, স্থানীয় হাটে চাহিদা শূন্য। আমরা লোকসানের মুখে পড়ছি।’

গ্রামের মানুষের মাঝে অ্যানথ্রাক্সবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে বৈঠক। ছবি: সংগৃহীত
কাউনিয়ার মধুপুর গ্রামের কৃষক নরেশ চন্দ্র বর্মণের অবস্থা আরও করুণ। তার তিনটি গরুর মধ্যে একটি জরুরি বিক্রি দরকার, কিন্তু হাটে দাম কম দেখে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছেন। সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কাছে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্সের খবর ছড়িয়ে গেছে, অনেকে এখন গরু পালন করতে চান না। এতে আমাদের পেশা বাঁচবে কীভাবে?’
দেউতি এলাকার মুদি দোকানি মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আগস্ট থেকে মাংস খাওয়া বন্ধ করেছি। গ্রামের অধিকাংশ লোক এখন গরুর মাংস এড়িয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ সচেতনতায় কাজ করছে। আমিও লোকজনকে সতর্ক করছি।’
স্থানীয় কসাই জব্বার আলী সারাবাংলাকে জানান, আগে প্রতিদিন তিনটা গরু জবাই করতেন। এখন একটা করলেও মাংস বিক্রি হয় না। তিনি সুস্থ গরুই জবাই করছেন, কিন্তু চাহিদা নেই। কাউনিয়ার পাইকার আকমল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাইরের পাইকাররা এলে সবাই লাভবান হতাম। এখন স্থানীয়রা কিনলেও বিক্রি করতে পারছেন না। দাম কিছুটা কমিয়ে কিনছি, কিন্তু এটা চলতে পারবে না।’
প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, রংপুরে প্রায় ১৩ লাখ গবাদিপশু রয়েছে। গত ২৬ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি পশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ছয়টি উপজেলায় মোট ১ লাখ ৬৭ হাজার গবাদিপশুকে টিকা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে পীরগাছায় ৫৩ হাজার ৪০০, কাউনিয়ায় ৩৪ হাজার এবং মিঠাপুকুরে ৩৪ হাজার ৫০০। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে টিকাদান শুরু হয়েছে। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো পশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
পীরগাছা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা একরামুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কৃষকদের অসচেতনতার কারণে শতাধিক গরু মারা গেছে। কিন্তু টিকাদান শুরুর পর কোনো ঘটনা হয়নি। আমরা ৫৩ হাজার ৪০০ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছি, আরও ৫০ হাজারের চাহিদা দিয়েছি।’
তবে স্থানীয়রা বলছেন, সচেতনতা এখনো যথেষ্ট নয়। অনেকে অসুস্থ পশু জবাই করছেন। এই অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক শুধু স্বাস্থ্যের নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিকেও সংকটে ফেলছে। খামারিরা আশা করছেন, অ্যানথ্রাক্স দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে, এবং তারা তাদের জীবিকা ফিরে পাবেন। প্রশাসনের উদ্যোগ কতটা কার্যকর হয়, তা এখন সময়ের ওপর নির্ভর করছে।
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ সারাবাংলাকে জানান, নতুন কোনো আক্রান্ত পশু পাওয়া যায়নি। মসজিদ-মন্দির, হাটবাজারে সচেতনতা কার্যক্রম চলছে। স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে যত্রতত্র পশু জবাই বন্ধ করা হয়েছে। মাঠে ১২টি মেডিকেল টিম কাজ করছে, এবং ৩৬টি কসাইখানায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু আছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে ‘ওয়ান হেলথ’ কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয় করে জনসচেতনতা বাড়াচ্ছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘উঠান বৈঠক, পথসভা ও প্রশিক্ষণ চলছে’।