ঢাকা: ৫ আগস্ট ২০২৫। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পতন। এর পর শেখ হাসিনা দেশে ছেড়ে পালিয়ে গেলে দলটি রাজনৈতিক অবস্থান হারায়। এমনকি তাদের জোটসঙ্গী ১৪ দলও রাজনীতিতে ফিরতে পারছে না। তবে এখন মাঠে রয়েছে শক্তিশালী বিএনপি, তাদের সাবেক মিত্র জায়ামাতে ইসলামী এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফসল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সেইসঙ্গে অপরাপর দলগুলো মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
তবে প্রশ্ন উঠছে, বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্ররা এখন কোথায়, কার সঙ্গে আছে? ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক মাঠে পুরোনো অনেক মিত্রই এখন বিএনপির সঙ্গে নেই। এদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী আলাদা পথ বেছে নিয়ে বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এর বাইরে কেউ আলাদা পথে হাঁটছে, কেউ দল গোছাচ্ছে, আবার কেউ জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধছে। এ অবস্থায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পুরানো মিত্ররা কোন বলয়ে থাকবে, কী ভূমিকা রাখবে ভোটে- তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ।
জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সখ্যতা শুরু ১৯৯১ সালে। এরশাদ পতন পরবর্তী সময়ে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে ১৪০টি আসন পায়। কিন্তু সরকার গঠনে প্রয়োজন ছিল ১৫০ আসন। ওই নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসনে জয়ী হয়। এক পর্যায়ে তারা বিএনপিকে সমর্থন জানালে সরকার গঠনে সক্ষম হয়। তখন থেকেই মূলত জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির একটি সখ্য গড়ে ওঠে। তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন মিলিয়ে বিএনপি ১৫৪ আসন হয়ে গেলে সরকার ধরে রাখার জন্য বিএনপির আর জামায়াতকে প্রয়োজন হয় না। ফলে ধীরে ধীরে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামী বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। এর পর তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে এক মাসের কিছু বেশি সময় থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে পাস করে পদত্যাগ করে। ওই ’৯৬ সালেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়। তখন জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এ সময় জামায়াতও ওই সরকারের পক্ষে ছিল। তবে একবছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে ফের বিএনপিমুখী হয় জামায়াত। ওই বছর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, জাগপা, পিএনপি, এনডিএ এবং ডেমোক্রেটিক লীগ সমন্বয়ে সাত দলীয় জোট গঠনের মাধ্যমে জোট রাজনীতি শুরু করে বিএনপি।
পরবর্তী সময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সাতদলীয় জোট বিলুপ্ত করে ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে গঠন করা হয় চারদলীয় জোট। পরে নির্বাচনের কিছুদিন আগে এরশাদ চার দলীয় জোট ত্যাগ করলে জাপার তৎকালীন মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু (বর্তমান বিজেপি নেতা আন্দালিভ রহমান পার্থের বাবা) জাপার একটি অংশ নিয়ে জোটে থেকে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে এই জোট ক্ষমতায় এলে চারদলীয় জোট সরকার নামে প্রতিষ্ঠা পায় বিএনপির শাসনামল। ওই সরকারের নাম ছিল মূলত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ খালেদা জিয়ার সরকারের শেষদি ন পর্যন্ত পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন।
২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, আওয়ামী লীগ সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এক/এগারো সরকার আসে। তারা দু’বছর দেশ পরিচালনা করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন দেয়। ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শুরু হয় নিপীড়ন, নির্যাতন, মামলা, হামলা, গ্রেফতার, গুম, খুন। ২০১১ সালে হাইকোর্টের আদেশের পর সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়। এর বিরুদ্ধে জামায়াত-বিএনপিসহ জোটের শরীক দলগুলো এক হয়ে আন্দোলনে নামে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে না এনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ জোট সরকার দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন করে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সেই নির্বাচন বর্জন করে। চলতে থাকে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। এতে জামায়াত অনেকটা নাখোশ হলেও যেহেতু তাদের নিবন্ধন ছিল না, তাই তারা জোটে থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়। সে বছর রাতের ভোটে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আস্তে আস্তে জোটের মধ্যে ভাঙন শুরু হয়। ওই সময় থেকে জামায়াত নেতারা বিএনপির বিরুদ্ধে, আবার বিএনপির কিছু নেতা জামায়াতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। তখন থেকে বাড়তে থাকে দূরত্ব।
২০২৪ সালে আবার সবকিছু ভুলে জুলাই আন্দোলনে এক কাতারে আসে সব দল। জামায়াত-বিএনপিসহ অন্তত ৬৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। এরা সবাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অক্সিজেন যোগায়। আসে সুফল। কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী তাদের সেই ঐক্য আর টিকে থাকেনি। প্রথমেই শুরু হয় জামায়াত-বিএনপির বাকযুদ্ধ। একদল আর আরেক দলের ওপর দোষারোপ শুরু করে। নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু হয়। বিএনপি ৩১ দফার ছায়াতলে সব দলকে ডাকে। কিন্তু জামায়াত বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ এনে নিজেরা নতুন জোট গঠনের দিকে এগিয়ে যায়।
জানা গেছে, জামায়াত কিছুটা সফলও হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি বড় ইসলামিক দল জামায়াতের সঙ্গে সুর মিলিয়ে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ফেলাফত মজলিস, ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপা, আল্লামা সরওয়ার কামাল আজিজির বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি। যদিও দলগুলো এখনই স্বীকার করছে না যে, তারা নির্বাচনে এক জোট হবে। তবে তাদের কার্যক্রম এবং পিআর দাবিতে দেওয়া অভিন্ন কর্মসূচি থেকেই বোঝা যাচ্ছে তারা এখন আর বিএনপির সঙ্গে নেই। কারণ, বিএনপি কোনোক্রমেই পিআর নির্বাচনে একমত নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিত্রদের বড় অংশ বিএনপির সঙ্গেই আছে। তবে কিছু ইসলামিক দল জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতা করছে বলে জানতে পেরেছি। তফসিল ঘোষণার পর বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আর ওই দলগুলো যদি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলাম আন্দোলনের কাতারে শামিল হয়ে জোট করে তাহলে বিএনপির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ আসতে পারে।’
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ২০১২ সাল থেকে জোটে আছি। ২০২২ সালে জোট ভেঙে গেলেও আমরা বিএনপির সঙ্গেই আছি। এরই মধ্যে আমরা আমাদের দলের প্রার্থীদের তালিকা দিয়েছি।’ কয়টা আসন চেয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটা কনফিডেন্সিয়াল, তাই বলব না।’
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান ও ১২দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নানা নির্যাতন সহ্য করেছি। লোভ-লালসা ত্যাগ করে বিএনপির সঙ্গে ছিলাম। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অতীতের মতো আগামী দিনেও আমাদের নিয়ে একসঙ্গে চলতে চান, কাজ করতে চান। আমরাও নির্বাচনি মাঠে বিএনপির পাশে থাকব।’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘ দিন এক হয়ে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছি। তখন আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছিল। ৫ আগস্ট পরবর্তী স্বৈরাচার সরকার পলায়নের পর সকল রাজনৈতিক দল নিজস্ব স্বাধীনতা ভোগ করছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব বিবেচনায় রাজনীতি করবে- এটাই গণতন্ত্র। বিএনপি একটি ওপেন দল। সবসময় সবাইকে নিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে চায়। আমরা সবদলকে একত্র করে ৩১ দফার আলোকে এগিয়ে যেতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘এগিয়ে যাওয়ার রাজনীতি যারা চাইবে, সবাই আমাদের সঙ্গী হতে পারবে। আমাদের দরজা সবার জন্য খোলা। আবার কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনায় এগিয়ে যেতে চায়, তাদেরও আমরা স্বাগত জানাই।’
মিত্রদের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কতটি দল বিএনপির সঙ্গে আছে তার হিসাব নেই। তবে বিগত দিনে যারা আন্দোলন-সংগ্রামে একসঙ্গে ছিলাম তাদের অধিকাংশ দল এখনো বিএনপির সঙ্গেই আছে। জামায়াতের নেতৃত্বে কয়েকটি ইসলামিক দল একটি জোট করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা এখনো একমত হতে পারেনি। কারণ, এই দেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ছায়াতলে সবাই রাজনীতি করে। এখানে সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনো এক হতে পারবে না।’ আবার এক হলেও দেশের মানুষ তা গ্রহণ করবে না বলে জানান তিনি।