Friday 10 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডেঙ্গুতে মৃত্যু
শীর্ষে ঢাকা দক্ষিণ, কর্তৃপক্ষের দাবি— আক্রান্তরা বাইরের

মেহেদী হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১০ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৫ ১০:০৩

মুগদা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিট। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুহার সর্বোচ্চ হওয়ায় অঞ্চলটি এখন ডেঙ্গুর ভয়াবহতার শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগি ভর্তিতেও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ডিএসসিসি। তবে ডিএসসিসি এলাকায় ডেঙ্গুর ভয়বহতা মানতে নারাজ করপোরেশনের কর্মকর্তারা। এমনকি, গতবছরের তুলনায় এবার ডিএসসিসি এলাকার ডেঙ্গু রোগি প্রায় ৮০ ভাগ কম বলে দাবি সিইও’র।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি বছরের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২০ জনে, যার মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকাতেই ১০৭ জন। আর ৩২ মৃত্যু নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বরিশাল বিভাগ। একই সময়ে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৫২ হাজার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ৭ হাজার ৮৮৬ জন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ডিএসসিসি। এছাড়া, ১৪ হাজার ২৯৬ জন নিয়ে শীর্ষে বরিশাল বিভাগ। ২০২৪ সালের রিপোর্টে দেখা যায়, সে বছরও ডিএসসিসি এলাকায় একই সময়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্ত ছিল শীর্ষে।

বিজ্ঞাপন

তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মানতে নারাজ ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. নিশাত পারভীন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সব টারশিয়ারি হাসপাতালগুলো রয়েছে। যেই হাসপাতালে সারা বাংলাদেশের রোগি ভর্তি থাকে। এটাই হলো প্রধান কারণ। এখন যেটা ডিজি হেলথ থেকে রিপোর্ট করে সেটা হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি থাকে সেইসব রোগীকে ডিএসসিসি লিখে দেয় এবং সেটাই ওয়েবসাইটে আসে। ফলে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় এতগুলো রোগি মারা গেছে।’

তিনি বলেন, ‘ডিএসসিসিতে গতকয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু রোগি অনেক কম। ধরা যাক আজ ঢাকা মেডিকেলে ১০০ জন রোগী আছে। সেই ১০০ জন রোগীর মধ্যে আমরা হয়তো একজন অথবা দু’জন পাব ডিএসসিসির। আর বাকি ৯৮ জনই ঢাকার বাইরের। কারণ, সব জায়গায় চিকিৎসা করে যখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়, তখন তারা ঢাকা মেডিকেল আসে। রোগিদের যে রিপোর্ট আসে আমরা সবগুলো একটা একটা করে আইডেন্টিফাই করি। এর পর বের করি কোন রোগি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার। হাসপাতালগুলোতে রোগির ঠিকানাগুলো বেশিরভাগই ঢাকার বাইরে। আর কিছু কিছু রোগি আছে ঢাকার বাইরে থেকে এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এখানকার আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা দেয়। এরকম বিষয় থাকে বেশিরভাগ। আর এখানে বাস করে এমন খুব অল্প রোগি আছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যে যেটা দেখাচ্ছে, সেগুলো সব ঢাকা দক্ষিণ করপোরেশনের রোগি না।’

এদিকে, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ মশা নিধনে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম জোরদার করেছে বলে দাবি করছে। তবে নাগরিকদের অভিযোগ, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও মশা মারার স্প্রে ছিটানো হচ্ছে না। ফলে অনেক এলাকায়ই জমে থাকা পানি এবং অপরিষ্কার পরিবেশ এডিস মশার বংশবিস্তারে সাহায্য করছে। এমনকি, অল্প কয়েক যায়গায় মশা মারার স্প্রে ছিটিয়েই কর্মীরা চলে যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ডিএসসিসির অনেক বাসিন্দাদের এমন অভিযোগের বিষয়ে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘ফগার মেশিন বা লার্ভিসাইটের জন্য কিন্তু ডেঙ্গু হয় না। আমরা ফগার মেশিন লার্ভিসেট নিয়মিত চালাচ্ছি। আমাদের লোকবল বেশি আছে, ওষুধও পর্যাপ্ত আছে। নিয়মিত কার্যক্রম ঠিকভাবে করা হচ্ছে। কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আসলে দরকার বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। এ নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে আমরা এবার বেশি কাজ করছি। ফলে এ বছর ডেঙ্গু অনেক কম আছে। যাদের দায়িত্ব তারা ফিল্ডে যাচ্ছে কি না সেটা আমরা অনলাইনে মনিটরিং করি। দুয়েক জায়গায় ১০৫০ জনের মধ্যে হয়তো ৫০ জন ভালো মতো কাজ করেনি। একহাজার জন তো ভালো কাজ করেছে। কোথাও সমস্যা দেখা দিলে আমাদের জানালে আমরা সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিই।’

ডিএসসিসি এলাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। তবুও নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সফলতার দাবি করেছে ডিএসসিসি। অথচ, এই এলাকায় ডেঙ্গু ভয়াবহতার চিত্রে জনমনেও বেড়েছে আতঙ্ক। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য নিয়ে ডিএসসিসি অপারগতা জানালেও এর বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। ফলে ডিএসসিসির দাবি ও বাস্তব চিত্রের ব্যবধানই এখন আলোচনার বিষয়।

গত বছরের চেয়ে চলতি বছর ডিএসসিসি এলাকার ডেঙ্গু রোগী প্রায় ৮০ ভাগ কম দাবি করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে যারা বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তারা সবাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা না। গতবছরের তুলনায় এবার ডিএসসিসি এলাকার ডেঙ্গু রোগী প্রায় ৮০ ভাগ কম। ডিএসসিসি বাসিন্দাদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে সেটা ডিএসসিসির না। তবে আমরা যদি ডোর টু ডোর একটা একটা কাজ করতে পারতাম তাহলে হয়তো একচুয়াল রেজাল্ট পাওয়া যেত।’

ডেঙ্গু বা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় আপনাদের তৎপরতার বা কোন ঘাটতি আছে কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভারী বৃষ্টিপাত ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি বড় রোল প্লে করে। তবে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ঝুঁকি বাড়ে। যেহেতু বৃষ্টি-বাদলের প্রভাব এখনো আছে, তাই আমরা অবজারভেশনে রাখছি। আমাদের ৭৫টা ওয়ার্ডে মশককর্মী আছে, যদিও সংখ্যায় কম। আবার নতুন ওয়ার্ডগুলোতে মশককর্মী নেই। সেগুলো আমরা বর্তমান লোকবল দিয়েই আমরা পূরণ করছি। বিভিন্ন ওয়ার্ড আমরা পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করছি। এটা চলমান প্রক্রিয়া।’

এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ঝুঁকিপূর্ণতা নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, সময়মতো চিকিৎসা শুরু না করা এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াই উচ্চ মৃত্যুর প্রধান কারণ। এছাড়া, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে দুর্বলতাও পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কেবল কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। বাসা-বাড়ির ভেতরে ও আশেপাশে পানি জমার মতো জায়গাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখা এবং মশার কামড় থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা নাগরিকদের জন্য আবশ্যিক। জ্বর এলেই দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। ডিএসসিসি এলাকায় এই উচ্চ মৃত্যুহার দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে জরুরি ভিত্তিতে আরও নিবিড় ও সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

২০২৫ সালের ডেঙ্গুর পরিস্থিতিতে দেখা যায়, গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ দ্বিগুণের চেয়েও বেশি এবং মৃত্যুও প্রায় দ্বিগুণ। চলতি বছরের আগস্টে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ৪৯৬ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৩৯ জনের। আর চলতি বছরের জুলাই থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করে। এই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ৬৮৪ জন এবং মৃত্যু হয় ৪১ জনের। আর সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৭৬ জন। আর হাসপাতালে ভর্তি হয় ১৫ হাজার ৮৬৬ জন।

২০২৪ ও ২০২৫ সালের বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, গতবছরের চেয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ৩১৫ জন বেশি। আর এই সময়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি ২৭ জন।

অপরদিকে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু পরিসংখানে এগিয়ে রয়েছে পুরুষ। ডেঙ্গুতে পুরুষ মারা গেছে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নারী মারা গেছে ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া, ডেঙ্গুতে পুরুষ আক্রান্ত হয়েছে ৬১ শতাংশ এবং নারী আক্রান্ত হয়েছে ৩৯ শতাংশ। তবে পুরুষ মানুষ বাহিরে কাজের জন্য বের হওয়া এবং বিভিন্ন স্থানে যাওয়ায় তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদরা।

সারাবাংলা/এমএইচ/পিটিএম

ডিএসসিসি ডেঙ্গু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মৃত্যু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর