চট্টগ্রাম ব্যুরো: জনগণের প্রতিবাদ বন্ধ করে একমাসের মধ্যে সরকার বিদেশিদের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে চুক্তি করতে চাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা গেলেন, মুহাম্মদ ইউনূস এলেন, তার ভাষাও ঠিক একইরকম।’
শনিবার (১১ অক্টোবর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর জিয়া স্মৃতি জাদুঘর সেমিনার হলে ‘জাতীয় সক্ষমতা ও জাতীয় নিরাপত্তা – চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে এ সভা হয়েছে।
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালনা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত আছে। এরপরও অন্তর্বর্তী সরকার একগুঁয়ের মতো আচরণ করছে। প্রধান উপদেষ্টা বিরোধিতাকারীদের প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন চট্টগ্রাম পুলিশ প্রশাসন একমাসের জন্য বন্দর এলাকায় যে কোনো সভা- সমাবেশ নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের সরকার সেই হাসিনার স্বৈরাচারী ভাষাতেই কথা বলছে। অর্থাৎ জনগণের প্রতিবাদ বন্ধ করে সরকার একমাসের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করতে চাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের মার্কিন কোম্পানি এসএসএর হাতে ১৯৮ বছরের জন্য লিজের চুক্তি করেছিল। কিন্তু তেল, গ্যাস বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা কমিটিসহ সর্বস্তরের জনগণ তখন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা রুখে দিয়েছিল। এবারও বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে এ চক্রান্ত প্রতিহত করা হবে।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের কথা উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিটি বিদেশের সঙ্গে যে কোনো চুক্তি করার আগে বিভিন্ন ফোরামে পর্যাপ্ত আলোচনা করার সুপারিশ করেছে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার তার নিজের গঠিত কমিশনের সুপারিশই মানছে না। কোনো আলোচনা ছাড়া এমনকি বিনা টেন্ডারে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর লিজের চুক্তি করতে যাচ্ছে।’
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে বন্দর পরিচালনার সম্ভাব্য চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড আবুধাবির কোম্পানি হলেও বাস্তবে এটি মার্কিন স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান। এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক-সামরিক গুরুত্বের জন্য আমেরিকা বাংলাদেশের ওপর নজর দিয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের মতো জাতীয় নিরাপত্তার সাথে যুক্ত একটা জাতীয় সম্পদ কোনোভাবেই বিদেশিদের হাতে দেওয়া চলবে না।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘রামপাল, রূপপুরের মতো বড় প্রকল্পের বিষয় কথা বলতে গেলে আগের সরকারের তল্পিবাহক লোকজনেরা বলতেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তাকে দিয়ে এই দেশের কোনো ক্ষতি হবে না, তাই প্রশ্ন দরকার নেই, টেন্ডার দরকার নেই, স্বচ্ছতার দরকার নেই, শেখ হাসিনা আছেন, তিনি সবকিছু দেখবেন। একটা পর্যায়ে তো শেখ হাসিনা চলেই গেলেন। মুহাম্মদ ইউনূস এলেন, তার ভাষাও ঠিক একই রকম। তার তল্পিবাহক যারা, তারাও বলছেন, উনি আছেন, কোনো অসুবিধা হবে না। এখনো কিন্তু ওই কথাটা আসছে, এই যে টেন্ডার করা লাগবে না- মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বিশ্বব্যাংক বলেছে। এখনো কিন্তু টেন্ডার ছাড়াই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া হোক বলা হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে গেলে তা জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে উল্লেখ করে তিনি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনার দাবি জানান।
সভায় দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার আমলে চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিন এসএসএ কোম্পানির হাতে ১৯৮ বছরের জন্য লিজ দেওয়ার সেই অসম চুক্তির কথাই মনে পড়ে। তখন বামপন্থীদের বন্দর রক্ষা কমিটি, তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনের মুখে চুক্তিটি বাতিল করতে বাধ্য হয়।’
‘পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতি তাদের বন্দর পরিচালনার ভার ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে তুলে দিয়ে কী রকম গ্যাঁড়াকলে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাতিল করেও যে তাদের জাল থেকে এখনো বেরোতে পারেনি, তা দেখছি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এসব তথ্য-উপাত্ত ও সতর্কবার্তা কানে তুলতে নারাজ। বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ম্যান্ডেট বর্তমান সরকারকে কে দিয়েছে ?’
গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন চট্টগ্রামের সংগঠক আসমা আক্তারের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দর সিবিএর সাবেক সেক্রেটারি শেখ নূরুল্লাহ বাহার, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য ফেরদৌসি রুমি।
নির্ধারিত আলোচনার পর মতামত দেন বন্দর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হালিমা খাতুন, প্রকৌশলী সিঞ্চন ভৌমিক এবং শ্রমিক নেতা রাহাতউল্লাহ জাহিদ।