ঢাকা: জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শিগগিরই রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে। কিন্তু তার আগে চূড়ান্ত করতে হবে প্রতীক। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ইসি ও এনসিপির মধ্যে চিঠি চালাচালি এবং বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু প্রতীক ইস্যুতে দুই ভিন্ন অবস্থানে অনড় এনসিপি ও ইসি।
শুরু থেকেই দলীয় প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ চেয়ে আসছে এনসিপি। কিন্তু এটি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য তৈরি করা প্রতীকের তালিকাতেই নেই। এর বদলে গেজেটভুক্ত ৫০টি প্রতীক থেকে যেকোনো একটি নিতে এনসিপিকে চিঠিও দেয় কমিশন। এনসিপি সেই চিঠির জবাবও দিয়েছে। তবে জবাবে দলটি ফের ‘শাপলা’ প্রতীক েচয়ে এর কয়েকটি নমুনাও পাঠিয়েছে।
এনসিপি বলছে, নির্বাচন কমিশনের তালিকাভুক্ত ৫০টি প্রতীকের কোনোটিই নেবে না তারা। তাদের দাবি, শাপলা প্রতীক। দলটির কোনো কোনো নেতা অবশ্য এও বলেছেন, ‘শাপলা’ ছাড়া অন্য কোনো প্রতীক দিলে তারা নির্বাচনেই অংশ নেবে না।
অন্যদিকে ইসি বলছে, গেজেটভুক্ত প্রতীক থেকেই তাদের দলীয় প্রতীক নিতে হবে। এনসিপি ও নির্বাচন কমিশনের এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের কারণে এখন প্রশ্ন উঠেছে- কেন এই অনড় অবস্থান? আসল সমস্যা বা বাধা কোথায়? আর প্রতীক বিষয়ে সমাধান-ই বা কী?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারবিষয়ক কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলির সঙ্গে। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘জাতীয় প্রতীকে ধানের শীষ, সোনালি আঁশ পাট, আর তারা চিহ্ন আছে। এছাড়া, দেশের আইন সংবিধানের প্রধান স্তম্ভ সুপ্রিম কোর্টের প্রতীকেও কিন্তু দাঁড়িপাল্লা রয়েছে। আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠালও ইসি প্রতীকের তালিকাতে রয়েছে।’ তাই ‘শাপলা’কে কোনো রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রতীক হিসেবে দিতে বাধা দেখেন না তিনি।
তিনি বলেন, ‘শাপলা প্রতীক কমিশনের তালিকাতে নেই, তাই কমিশন দিতে পারেনি। তবে, সম্প্রতি তালিকায় নতুন প্রতীক যুক্ত করেছে ইসি। সে সময় চাইলে কমিশন শাপলা প্রতীক যুক্ত করতে পারতো।’ তাহলে এই মুহূর্তে সমাধান কী? এমন প্রশ্নের জবাবে জেসমিন টুলি বলেন, ‘উদ্ভুত পরিস্থিতিতে যেকোনো একপক্ষকে সমঝোতা করে মেনে নিতে হবে।’ আর ‘শাপলা’ প্রতীক না দিতে চাইলে এর সঠিক ব্যাখ্যা ইসিকে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন সাবেক এই নির্বাচন কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বিধিতে শাপলা নেই, তাই ইসি দিতে পারছে না। এখন অনড় অবস্থানের কারণে হয়তো ইসি বিধি পরিবর্তন করে শাপলা প্রতীক যুক্ত করতে পারে।’ ‘কিন্তু ইসির একটা সিদ্ধান্ত পছন্দ হলো না, আর আমি ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য করলাম। এই প্রক্রিয়া চালু হলে ইসির পক্ষে কি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে?’- এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যখন প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা বাছাই হবে, তখন ইসি বলল- নিয়ম অনুযায়ী আমি প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য। তখন কোনো বড় রাজনৈতিক দল বলল- আমরা মানি না, শাহদীন মালিক প্রার্থী না হলে আমরা নির্বাচন করব না। তখন কী হবে? ইসি যদি একটি দলের চাপে সিদ্ধান্ত বদল করে ফেলে, তাহলে ছয় মাসের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতে পারে।’
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘বিভিন্ন দলের বিভিন্ন দাবি যদি নির্বাচন কমিশন না মানে। আর সেজন্য যদি নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করে তাহলে কাকে দোষ দেওয়া হবে?’ তাই তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘যদি শেষ পর্যন্ত ইসি এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেয়, তাহলে ইসির সিদ্ধান্তে অটল থাকার বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। তখন সবাই বলবে, এনসিপির দাবি মানলেন, আমাদেরটা কেন মানলেন না।’ তাই ভবিষ্যতের জন্য বিষয়টি কমিশনকে ভেবে-চিনতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দেন এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
এদিকে শাপলা প্রতীক ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শাপলা প্রতীক তফসিলে না থাকায় তা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়। যা এরই মধ্যে এনসিপিকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। এখন তারা শাপলা প্রতীক ছাড়া নিবন্ধন নেবে নাকি নেবে না, সেইটা তাদের দলীয় বিষয়, কমিশনের নয়।’ তবে সিনিয়র এই সচিব জানান, শাপলা প্রতীকের দাবির বিষয়ে ইসির সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অন্যদিকে এনসিপির অভিযোগ, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে ইসির এই সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে গত ৯ অক্টোবর ইসির সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করে এনসিপি। সেই বৈঠক শেষে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ইসি গত মিটিংয়ে আমাদের ডিজিএফআই’র কিছু উদাহরণ দিয়েছিল, বিভিন্ন সংস্থার উদাহরণ দিয়েছিল। সে বিষয়ে আমরা আজ বলেছি যে, আপনারা যদি কোথাও থেকে প্রেসার ফিল করেন, বা কেউ আপনাদের চাপ দিয়ে থাকে, সেটা জানান। আমরা আপনাদের কিছু বলব না। আমরা তাদের রাজপথে মোকাবিলা করব।’
তিনি বলেন, ‘কোনো অদৃশ্য শক্তি পেছনে রেখে আপনি (ইসি সচিব) প্রেসারটা নিয়েন না। আপনি এমনি অসুস্থ মানুষ। আপনি এ ধরনের প্রেসার সহ্য করতে পারবেন না। তারপরে উনি চুপ ছিল। কিন্তু যেহেতু ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আমরা ওনাদেরকে বলে দিয়েছি যে, নিবন্ধন যদি আমাদের দিতে হয় শাপলা দিয়েই দিতে হবে। শাপলা ছাড়া এনসিপির নিবন্ধন হবে না। এনসিপিও শাপলা ছাড়া নিবন্ধন মানবে না। আমরা শাপলার ক্ষেত্রে অনড় আছি, অনড় থাকব।’
বৈঠকে ইতিবাচক আলোচনার ইঙ্গিত দিয়ে নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, ‘আশা করি শাপলা প্রতীক পাব। এটা না পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি বা রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা নেই।’ এনসিপির এই নেতার বক্তব্য, জাতীয় প্রতীক হিসেবে শুধু শাপলা আছে, বিষয়টি এমন নয়। ধানের শীষ, সোনালি আঁশ, এমনকি তারা চিহ্ন তাও আছে। তাই প্রতীক হিসেবে ধানের শীষ, সোনালি আঁশ বাদ দিতে হবে। না হলে শাপলা দিতে হবে।
তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি দলীয় প্রতীক ‘শাপলা’ পাচ্ছে কি না- সে বিষয়ে জানতে অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন কমিশনের পরবর্তী সভা পর্যন্ত।