রংপুর: আর্থিক সীমাবদ্ধতা, চরম শিক্ষক-শ্রেণিকক্ষ সংকট, পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধার অভাব, প্রশাসনিক জটিলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ।
রোববার (১২ অক্টোবর) ‘শিক্ষা, গবেষণা এবং বিপ্লবের চেতনায় দীপ্ত হোক—বেরোবির আগামী’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। জুলাই ছাত্র-জনতা বিপ্লবের প্রথম শহিদ আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত করে আত্মত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সারা বিশ্বে বিশেষ পরিচিতি এনে দিয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে ক্যাম্পাসে সাজানো হয়েছে রঙিন ফেস্টুন, বেলুন এবং আলোকসজ্জায়।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে নামকরণকৃত এই বিশ্ববিদ্যালয়, ১৭ বছরের যাত্রায় অর্জনের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এগিয়ে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই উদযাপন শুধু স্মৃতির উৎসব নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রত্যয়ের একটি মাইলফলক।
সেই বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে রংপুরে একটি পূর্ণাঙ্গ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছিল। দীর্ঘ আন্দোলনের পর, ২০০৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরপর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান লালকুঠি এলাকায় টিচার্স ট্রেইনিং কলেজে ২০০৮ সালের আজকের দিনে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ এর কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম লুৎফর রহমান দায়িত্ব পেয়েছিলেন মাত্র ৬ মাস। আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরুর পর ৩০০ ছাত্র-ছাত্রী এবং ১২ জন শিক্ষক আর পরিত্যক্ত দুটি কক্ষ নিয়ে কার্যক্রম চলেছিল অস্থায়ী ক্যাম্পাসে।’
অস্থায়ী ক্যাম্পাস থেকে ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি কারমাইকেল কলেজের ৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে নিজস্ব ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য ড. মু. আব্দুল জলিল মিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিকাংশ অবকাঠামো তার হাত ধরে গড়ে উঠলেও নানা দুর্নীতির অভিযোগে তিনি মেয়াদপূর্তির এক দিন আগেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন-নবী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণকালে বিগত প্রশাসনের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগজনিত জটিলতা ও আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হোন। তবে পুরো মেয়াদকালে বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন ও সমালোচনার মধ্যে দিয়ে অধ্যাপক নূর-উন-নবী মেয়াদ পূর্ণ করে চলে যান।
পরবর্তীতে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনিও নানা সমালোচনার জন্ম দেন। তার বিরুদ্ধে বেশির ভাগ সময় ক্যাম্পাসে না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করেছিলেন। তার চার বছর মেয়াদ শেষে অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশিদ দায়িত্ব পান। দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরের মাথায় ২০২৪ সালের জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনিও ৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করেন।
সর্বশেষ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাপক ড. শওকাত আলীকে দেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি উত্তরের বিদ্যাপীঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে তোলার আশা ব্যক্ত করেন। দুঃখজনকভাবে প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও কোনো উপাচার্য এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেননি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতা, চরম শিক্ষক-শ্রেণিকক্ষ সংকট, পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধার অভাব এবং প্রশাসনিক জটিলতা এখনও চ্যালেঞ্জ। কোনো সংবিধি বা প্রবিধি না থাকা, টিএসসি, অডিটরিয়াম বা জিমনেশিয়ামের অভাব এবং বেগম রোকেয়ার প্রতিকৃতির অনুপস্থিতি ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র এনামুল হক শাওন বলেন, এই দিবস আমাদের শেখায় ঐক্য এবং দায়িত্ববোধ, কিন্তু আমরা চাই পর্যাপ্ত সুযোগ এবং আধুনিক পরিবেশ।
ইংরেজি বিভাগের মোহাম্মদ বায়েজিদ বোস্তামী বলেন, ‘আবাসন সংকটে ৯০ শতাংশ ছাত্র বঞ্চিত, যা আমাদের সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২২টি বিভাগ চালু রয়েছে, যেখানে প্রায় ৮,৫০০ ছাত্র-ছাত্রী এবং ২০১ জন শিক্ষক কর্মরত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাচেলর, মাস্টার্স, এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, এবং ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গবেষণাকে উৎসাহিত করছে। সম্প্রতি ওয়েব ম্যাট্রিক্স র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি ২৩তম স্থানে উঠে এসেছে, যা গত বছরের তুলনায় আট ধাপ উন্নতি। অবকাঠামোর দিক থেকে চারটি আবাসিক হল (একটি নির্মাণাধীন), প্রশাসনিক ভবন, চারটি একাডেমিক ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি (ডিজিটালাইজড), মসজিদ, ক্যাফেটেরিয়া, মেডিকেল সেন্টার এবং সাতটি নতুন বাস যোগ হয়েছে। গবেষণায় সীমিত অর্থ বরাদ্দ সত্ত্বেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করে সুনাম অর্জন করছেন।
উপাচার্য ড. শওকাত আলী বলেন, ‘আমরা গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছি এবং শিক্ষক নিয়োগের কাজ শুরু হয়েছে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে পরিণত করা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জীবনও সমৃদ্ধ। বাংলা নববর্ষ, রোকেয়া দিবস, ভাষা দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের পাশাপাশি বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, ডিবেটিং সোসাইটি এবং গ্রিন ভয়েসের মতো সংগঠনগুলো ছাত্রদের নেতৃত্ব দক্ষতা বাড়াচ্ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (বেরোসাস) তরুণ সাংবাদিক তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক দায়বদ্ধতায়ও বিশ্ববিদ্যালয় সক্রিয়—রক্তদান, বৃক্ষরোপণ এবং ত্রাণ কার্যক্রমে ছাত্ররা অংশ নিচ্ছেন। জুলাই ছাত্র-জনতা বিপ্লবে শহীদ আবু সাঈদের স্মৃতি এই ক্যাম্পাসকে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে, যা আজকের অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত হয়েছে।
ভবিষ্যতে ,বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে মনোনিবেশ করছে। উপাচার্য জানিয়েছেন, আগামী ২০ ডিসেম্বর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে এবং ছাত্রসংসদ নির্বাচনও নির্ধারিত সময়ে হবে।
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম মমিন বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখি একটি গবেষণামুখী বিশ্ববিদ্যালয়ের, যা বেগম রোকেয়ার আদর্শকে বাস্তবে রূপ দেবে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তুহিন রানা বলেন, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং ঐক্যবদ্ধতায় আমরা বৈষম্য দূর করব।’
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে কর্মসূচি শুরু হবে। তারপর শোভাযাত্রা, কেক কাটা এবং জুলাই আন্দোলনে আহতদের সংবর্ধনা।
অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদের তৎকালীন আহ্বায়ক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. রেজাউল হক। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। প্রধান আলোচক থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. লুৎফর রহমান এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বিকেলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মিলাদ মাহফিল এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি শেষ হবে।