রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে তুমুল আলোচনা। নির্বাচনের বাকি আর মাত্র দু’দিন। প্রচার-প্রচারণা, পোস্টার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরবতা— সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে এখন নির্বাচনি উত্তাপ। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে প্রতিটি হল প্রাঙ্গণে জোরেশোরে চলছে প্রার্থীদের প্রচার। তবে একই সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সিনেট-এ ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচন। কিন্তু এটা নিয়ে আলোচনা তুলনামূলকভাবে কম। অনেক শিক্ষার্থীই জানেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ এই নীতিনির্ধারণী ফোরামটি কীভাবে কাজ করে। কিংবা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কী ভূমিকা রাখেন।
সিনেট কী, কেন?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সিনেট হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা, যা ১৯৭৩ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী গঠিত। সিনেটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর কাজের মধ্যে রয়েছে উপাচার্য নির্বাচন, নতুন বিভাগ বা ইনস্টিটিউট খোলা, বার্ষিক বাজেট অনুমোদন, আইন ও বিধিমালা সংশোধনসহ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা, প্রশাসনিক কাঠামো ও সামগ্রিক উন্নয়ন পরিচালনায় সিনেটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিনেটের সভাপতি পদাধিকারবলে উপাচার্য (ভিসি)। সদস্য হিসেবে থাকেন দু’জন উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ। এছাড়া, রয়েছেন ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, গবেষণা সংস্থার পাঁচ প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতি তথা আচার্য মনোনীত পাঁচ জন শিক্ষাবিদ, সরকার মনোনীত পাঁচ জন সরকারি কর্মকর্তা এবং শিক্ষক মনোনীত পাঁচ জন সংসদ সদস্য। তাছাড়া অধিভুক্ত কলেজের অধ্যক্ষদের ছয় জন প্রতিনিধি, শিক্ষা পরিদর্শক কর্তৃক মনোনীত ১০ জন কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন শিক্ষা বোর্ডের দু’জন চেয়ারম্যান, শিক্ষকদের ভোটে নির্বাচিত ৬৩ জন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত পাঁচ জন ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছেন। সব মিলিয়ে সিনেটের মোট সদস্য সংখ্যা ১০৪ জন।
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী উপাচার্য বছরে অন্তত একবার সিনেট অধিবেশন আহ্বান করেন, যা বার্ষিক সভা হিসেবে গণ্য হয়। প্রয়োজনে বিশেষ সভাও আহ্বান করা যেতে পারে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সিনেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৯ মে। এর পর দীর্ঘ নয় বছরেও আর কোনো পূর্ণাঙ্গ সিনেট সভা হয়নি। প্রায় এক দশক পর আসন্ন ২০২৫ সালে রাবিতে নতুন করে সিনেট-এ ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একযোগে এই নির্বাচন হবে। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচন-২০২৫
এবারের সিনেট-এ ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচনে পাঁচটি পদের বিপরীতে মনোনয়নপত্র তুলেছিলেন মোট ৮৪ জন। তবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে মোট ৫৮ জন প্রার্থী লড়াই করছেন।
সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের ভিপি ও সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিনেট কেবল একটি নীতিনির্ধারণী সংস্থা নয়, বরং এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদণ্ড। আমি বিশ্বাস করি, একজন সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করেন। রাকসু যেখানে মূলত শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে, সিনেট সদস্যদের দায়িত্ব আরও বিস্তৃত। তারা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী— সকলের অধিকার ও স্বার্থ তুলে ধরেন।’
তিনি সংসদের সঙ্গে সিনেটের তুলনা করে বলেন, ‘সংসদ যেমন দেশের নীতি ও বাজেট নির্ধারণ করে, তেমনি সিনেটও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট, একাডেমিক নীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণা খাত ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করে। আমি নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীবান্ধব বাজেট প্রণয়ন, হলের সিটসংকট সমাধান, গ্রন্থাগারের মানোন্নয়ন, আইসিটি সুবিধা উন্নয়ন এবং ক্রীড়া-সংস্কৃতিচর্চায় বরাদ্দ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত মতামত সংগ্রহ করে তা সিনেটে তুলে ধরব, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় আরও আধুনিক, গবেষণাভিত্তিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব হয়ে উঠতে পারে।’
ছাত্রদলের ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ ভিপি ও সিনেট প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন আবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলো সেই জায়গা যেখানে আগামী দিনের নীতি ও পরিকল্পনা নির্ধারিত হয়। সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি এই পদ শুধু মর্যাদার নয়, বরং দায়িত্ব ও কর্তব্যের। শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত রয়েছে। যেমন— আবাসন সংকট, ল্যাবরেটরি সংকট, পর্যাপ্ত গবেষণা তহবিলের অভাব, লাইব্রেরির হালনাগাদ বইয়ের ঘাটতি। এসব সমস্যা সরাসরি সিনেটে উত্থাপন করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা সম্ভব। আমি চাই, শিক্ষার্থীদের দাবি বাজেটে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হোক, গবেষণা ও উদ্ভাবনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো হোক এবং ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হোক।’
সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি প্রার্থী ও রাবি প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন মাহিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিনেট সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। রাকসু শুধু শিক্ষার্থী অধিকার আদায়ের কথা বলে। কিন্তু, সিনেট সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকল স্টেকহোল্ডাদের কথা বলে। সেই জায়গা থেকেই সকলের অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে কাজ করার জন্যই সিনেট পদপ্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি জানি ক্যাম্পাসের কোথায় কী সমস্যা, কোথায় অনিয়ম-দুর্নীতি ও কোন সেক্টরগুলোতে জোর দিলে বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূর এগিয়ে যাবে। সেই জায়গাগুলোতে আমার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারব বলে বিশ্বাস। নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের পরামর্শের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট পাস থেকে শুরু উপাচার্য নিয়োগের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করব।’
জুলাই আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি প্রার্থী তাসিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মতো। এখানে যেমন বৈচিত্র্য আছে, তেমনি আছে সমস্যা, বৈষম্য ও সংঘাত। আমি বিশ্বাস করি, একজন সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য সংসদ সদস্যের মতো। তার দায়িত্ব হলো— ন্যায়বিচার, সমতা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।’
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর এবারের রাকসু নির্বাচনে মোট ৯০৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রাকসুতে ২৪৮ জন, সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধি পদে ৫৮ জন এবং ১৭টি আবাসিক হল সংসদে ৫৯৭ জন প্রার্থী লড়ছেন। আগামী ১৬ অক্টোবর একযোগে অনুষ্ঠিত হবে রাকসু, হল সংসদ ও সিনেট-এ ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচনের ভোট। এরপর সেদিনই গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হবে।