Tuesday 14 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নোয়াখালীর চরাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠছে মহিষের খামার

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৪ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:০১ | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:৪৫

পুরুষদের পাশাপাশি এগিয়ে আসছেন নারী উদ্যোক্তারাও। ছবি: সারাবাংলা

নোয়াখালী: নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় চারণভূমি ও প্রাকৃতিক খাদ্য সংকটে কমে আসছিল নোয়াখালীর দেশীয় মহিষের খামারের সংখ্যা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জেলার উপকূলীয় এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে মহিষের কয়েকটি খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারে দেশী ও বিদেশী মুররা জাতের ৪-১০টি পর্যন্ত মহিষ রয়েছে। এসব খামার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি এগিয়ে আসছেন নারী উদ্যোক্তারাও।

সম্প্রতি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও স্থানীয় এনজিও ‘সাগরিকা’র মাধ্যমে সরকার স্বল্প পরিসরে মহিষের খামার সম্প্রসারণের সমন্বিত প্রকল্পও হাতে নেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সঠিকভাবে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করা গেলে মহিষের মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাদ্যের বাজার সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবন-মান আরো উন্নত হবে।

বিজ্ঞাপন

এক সময় বাথানেই দেশীয় জাতের মহিষ পালন করতেন সুবর্ণচর উপজেলার চর মহিউদ্দিন গ্রামের মালেক। কিন্তু চারণভূমি কমে যাওয়ায় ও সবুজ বেষ্টনি উজাড় হওয়ায় খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এতে তার বাথানগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। সম্প্রতি একটি সংস্থার ট্রেণিং নিয়ে খামারিরা নিজ বাড়িতেই পরিবেশ সম্মতভাবে গড়ে তোলেন মহিষের খামার। তবে আর্থিক সংকটের কারণে শেডগুলো সম্প্রসারণ করতে পারছেন না তিনি। কম পরিশ্রম ও স্বল্প খরচে গড়ে তোলা খামারে বর্তমানে বিদেশী মুররা জাত, ক্রস ও দেশীয় মিলে ১০টি মহিষ রয়েছে তার। দেশীয় মহিষের তুলনায় মুররা ও ক্রসে মিলছে বেশি দুধ ও মাংস।

মালেক আরও বলেন, এ খামারেই একদিন বড় খামার হবে বলে এমন প্রত্যাশা করছেন তিনি। বাড়ির পাশের ছোট্ট একটা জমিতে উন্নত মানের ঘাস চাষ করছেন। পাশাপাশি দানাদার কিছু খাবারও বাজার থেকে কিনছেন। তার মতে অল্প খাবারে মহিষ সন্তুষ্ট থাকে। বর্তমানে তার বিদেশী মুররা জাতের একটি মহিষ বাচ্চা দিয়েছে। তিনি ভালো দুধ পাচ্ছেন। অপর মহিষগুলোর মধ্যে মা মহিষ যেগুলো আছে সেগুলোও আগামী এক বছরের মধ্যে বাচ্চা দেবে। এতে করে তার খামার আরো বড় হবে। তিনি এখন খামারেই সময় দিচ্ছেন। প্রতিদিন এক কেজি দুধ বিক্রি করছেন ১২০ টাকা। মুররা জাতের মহিষ থেকে প্রতিদিন ৮-১০ কেজি দুধ পাচ্ছেন। দুধের বাজারও ভালো রয়েছে।

তিনি আশা করেন মহিষের খামার বড় হলে মাংসের জন্য যেমন মহিষ বিক্রি করতে পারবেন, অপরদিকে বছর খানেক পর থেকে প্রতিদিন গড়ে ২-৩ হাজার টাকার দুধও বিক্রি করতে পারবেন।

শুধু মালেক নয়, সুবর্ণচরের প্রত্যন্ত গ্রামে এখন মহিষের খামার দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন অনেকেই। এরইমধ্যে বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৪০টি খামার গড়ে ওঠেছে। দুধ ও মাংস বেশি হওয়ায় বিদেশী জাতের মুররা ও দেশীয় ক্রস জাতের প্রতি আগ্রহ খামারিদের।

খামারিরা বলছেন, দেশীয় জাতের একটি মা মহিষ দেড় থেকে ২ কেজি দুধ দিলেও মুররা দিচ্ছে ৮-১০ কেজি, আবার ১৫-২৫ মন পর্যন্ত মাংস হচ্ছে ক্রস ও মুররা জাতে। এতে দুধ ও মাংসের বাজার বড় হচ্ছে। ফলে, গরুর খামারের পাশাপাশি মহিষ খামারে আগ্রহী হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তারা। মহিষের খামারকে কেন্দ্র করে চরাঞ্চলে দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাদ্য উৎপাদনেও আগ্রহী হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা অব্যাহত থাকলে মহিষের খামার দেশের অর্থনীতিতে দারুন ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।

এমনই আরেক উদ্যোক্তা মেহরাজ এক সময় হাতিয়া উপজেলার নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে সুবর্ণচর উপজেলার আল আমিন বাজার সংলগ্ন নিজের ক্রয় করা কয়েক একরের একটি জায়গায় গড়ে তুলেছেন গরু ও মহিষের খামার। বর্তমানে সেখানে দেশী, বিদেশী ও ক্রস জাতের মিলিয়ে ১০০টি মহিষ রয়েছে। এর মধ্যে বিদেশী মুররা ও ক্রস জাতের রয়েছে ২০টি। বাথান হ্রাস পাওয়ায় বিদেশী জাতের মহিষ খামারে পালন শুরু করেছেন তিনি। তার মতে, খাবারসহ মহিষ পালনে সময় ও অর্থ দুটোই কম লাগে। বাজারে মহিষের দুধ ও মাংসের চাহিদা বেড়েছে। ফলে ভবিষ্যতে মহিষের দুধ ও মাংস দেশের আমিষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।

হাতিয়া উপজেলার হরনি ইউনিয়নের মাহিষ খামারি জহুরা বলেন, গরুর চেয়ে মহিষের খামারে লাভ বেশি। মহিষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় চিকিৎসা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।

সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নের তাহমিনা বেগম বলেন, গরুর চেয়ে মহিষ পালনে লাভ বেশি। মহিষে দুধ বেশি হয়, আবার দামও বেশি। যেখানে গরুর এক লিটার দুধের দাম ৬০ টাকা সেখানে মহিষের দুধ ১০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।

এ বিষয়ে সমাজ উন্নয়ন সংস্থা সাগরিকা’র নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, চরাঞ্চলে চারণভূমি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে দেশীয় মহিষের বাথান কমে যাচ্ছে। তাই সরকার বিদেশী ও দেশীয় ক্রস জাতকে বাড়াতে নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। গ্রামীণ জীবনমান টেকসই করতে বাথানের পাশাপাশি পরিবারকেন্দ্রিক পরিবেশবান্ধব মহিষ খামার গড়ে তুলতে মূলত সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার সংস্থা এ প্রকল্পকে সম্প্রসারণ করতে পিকেএসএফ-এর মাধ্যমে কাজ করছে।

তিনি বলেন, স্থানীয়দের মহিষ পালনে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মহিষের মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাদ্য উৎপাদনে এবং বাজার ব্যবস্থা উন্নয়নে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতাও করে আসছেন তারা। তাদের কারিগরি সহায়তা যেমন দেওয়া হচ্ছে, তেমনি বাজার ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য যেমন দই, মাখন, ঘি উৎপাদনে সহায়তা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নতজাতের মহিষের প্রজননের মধ্য দিয়ে নতুন টেকসই উদ্যোক্তা তৈরি করা গেলে চরাঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মান যেমন বাড়বে, তেমনি পুরো জেলার অর্থনীতিও আরো সমৃদ্ধ হবে।

এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা প্রানিসম্পদ কর্মকর্তা মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটি সম্পূর্ণ নতুন উদ্যোগ। তবে গত দুই বছরে এ উদ্যোগে বেশ সাফল্য দেখা গেছে। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন এনজিও যৌথভাবে এ প্রকল্প সম্প্রসারণে কাজ করেছে। এখন দেখা গেছে সাধারণ মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই খামার গড়ে তুলছেন। যা চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সত্যিই ভালো ভূমিকা রাখবে। অবশ্য এ জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা জোরদার করার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

সারাবাংলা/জিজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর