রংপুর: রংপুরের বাজারের প্রতিটি পণ্যে যেন জ্বলছে আগুন। আর সেই আগুনে পুড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবন, পুড়ছে তাদের ছোট্ট স্বপ্ন। শীতের আগমনি সবজির আমদানি শুরু হয়েছে, কিন্তু দাম কমার লক্ষণ নেই। বরং প্রতিটি সবজির দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকায় উঠে গেছে, যা খেটে খাওয়া মানুষের পকেটে ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে। গত কয়েকদিনের লাগাতার বৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। সেই ক্ষতির ছায়া পড়েছে কাঁচা বাজারে। ফলে, খেটে খাওয়া সাধারণ পরিবারের থালায় যেন শুধু অভাবের ছায়া নেমেছে।
নগরীর সিটি বাজার, লালবাগ, চকবাজার, ধাপ বাজার, আমতলি বাজারসসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেল, সবজির যে দাম তাতে সেগুলো নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরে। গোল বেগুনের কেজি ১০০-১২০ টাকা, লম্বা বেগুন ৮০-৯০ টাকা, করলা ৮০-৯০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৬০-৭০ টাকা, বরবটি ৬০-৭০ টাকা, মুলা ৫০-৬০ টাকা, পেঁপে ৬০ টাকা, কচুরমুখী ৬০ টাকা, টমেটো ১৬০ টাকা, শিম ২০০ টাকা; যেন প্রতিটি সবজি নিজের দামের ভারে নিম্ন আয়ের মানুষকে চাপিয়ে দিচ্ছে।
গরিবের সবজি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আলু ২০-২৫ টাকা কেজি, লাউয়ের পিস ৭০-৮০ টাকা। এই দামগুলো যেন গরিবের রান্নাঘরে শুধু অভাবের গন্ধের উদাহরণ। শাকপাতার দামও কম নয়; লালশাকের আঁটি ২০-২৫ টাকা, পুঁইশাক ৩০-৪০ টাকা, লাউশাক ৪০-৫০ টাকা—এই সামান্য শাক কিনতেও ক্রেদাদের মনে হলো হাত কাঁপে অনেকের।
সিটি বাজারে বাজার করতে এসে এক বেসরকারি চাকরিজীবী প্রশ্ন রাখলেন– ‘এই লাগামহীন দাম বৃদ্ধিতে একটা সাধারণ শ্রমিকের পরিবার কীভাবে চলবে?’ তিনি বলেন, ‘যেন প্রতিটি কেনাকাটায় হৃদয়ের একটা অংশ ছিঁড়ে যায়।’

শীতকালীন আগাম সবজি উঠেছে বাজারে। ছবি: সারাবাংলা
একটা পণ্যের দাম কমলে অন্যটির বাড়ে কয়েক গুণ—এই চক্রে আটকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। মাছের বাজারে তো আরও কষ্টের দৃশ্য। রুই ৩৬০-৩৮০ টাকা কেজি, পাঙ্গাস ২২০-২৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২৫০-২৭০ টাকা। যেন মাছ কেনা এখন বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাষের কই ২৮০-৩০০ টাকা, শিং ৬০০-৭০০ টাকা।
মুরগির দামও আকাশছোঁয়া। ব্রয়লার ২১০-২৩০ টাকা কেজি, সোনালি ৩০০-৩২০ টাকা। ডিমের হালি ৪৮-৫০ টাকা, যা গত সপ্তাহে যা ছিল ৪৪-৪৬ টাকা। গরুর মাংস ৭৫০-৮০০ টাকা, খাসির মাংস ১০৫০-১১০০ টাকা।
ভ্যানচালক বজলুর রহমান অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ‘এই দামে একটা গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা কী খাবে? এই দামে মাংস কেনা যেন স্বপ্নের মতো।’
ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজারে নিয়মিত মনিটরিং নেই, তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। এক ক্রেতা বলেন, ‘আমরা খেটে খাই। কিন্তু, বাজারে এসে হাত খালি করে ফিরি। ছেলেমেয়ের মুখে হাসি দেখার স্বপ্নটা আজ ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।’ বিক্রেতারাও বলছেন, কিছু অসাধু লোকের কারণে সবাই কলঙ্কিত হচ্ছে। নিয়মিত অভিযান চালালে এই দৌরাত্ম্য কমবে।

শীতকালীন আগাম সবজি উঠেছে বাজারে। ছবি: সারাবাংলা
বাজার বিশ্লেষণ করে জানা গেল, দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ দিশেহারা। চাল, ডাল, তেল, মসলা—সবকিছুর দাম বেড়ে চলেছে। কাঁচামরিচ ২০০-২৪০ টাকা কেজি, পেঁয়াজ আকারভেদে ৭৫-৮৫ টাকা—যেন প্রতিটি কেনাকাটায় ক্রেতার নাভিশ্বাস উঠছে।
স্টেশন বাজারের সবজি বিক্রেতা আরমান হোসেন বলেন, ‘শীতকালীন সবজি আসতে শুরু করেছে, কিন্তু দাম কমার লক্ষণ নেই। সামনে আরও আমদানি বাড়লে হয়তো কিছু স্বস্তি আসবে।’
স্থানীয় এক এনজিওকর্মী বলেন, ‘বাজারের আগুনে গরিবের সংসার, ছেলেমেয়ের হাসি পুড়ে যাচ্ছে। রংপুরের প্রতিটি গৃহস্থ ও অসহায় পরিবারের এই একটাই প্রশ্ন- কবে স্বস্তি ফিরবে বাজারে? কবে পেটপুড়ে খাবে সকলে?’ তার মতে, সরকারি মনিটরিং বাড়লে হয়তো এই আগুন নিভবে, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্টের শেষ নেই।