ঢাকা: আসছে বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা আছে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের অভয়ারণ্য রাজধানীর মোহাম্মদপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সবধরনের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও স্থায়ী সমাধান মিলছে না। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে- যখন একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না, তখন সারাদেশে নির্বাচনের মতো সংবেদনশীল দায়িত্ব পালনে তারা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে?
অনুসন্ধানে উঠে আসে, গণঅভ্যুত্থানের পর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, কিশোর গ্যাং, আধিপত্য বিস্তার ও মাদককারবারিদের আধিপত্যে দীর্ঘদিন ধরেই অস্থির এই এলাকা। প্রায়ই প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে প্রায়ই চালানো হচ্ছে সেনাবাহিনী, সিআইডি, র্যাব, পুলিশ ও আনসারদের যৌথ অভিযান। কিন্তু তার পরও অপরাধ যেন কমছেই না।
মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় বসবাস করেন সুমন পারভেজ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এই এলাকায় বসবাস করি। ৫ আগস্টের পর বেপরোয়াভাবে এখানে দিনে-দুপরে অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। যাকে ইচ্ছা তাকে কুপিয়ে ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে। আগে পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল। এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এখনো সন্ধ্যার পর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় বের হতে ভয় পাই। এমন অবস্থায় আগামী নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা স্বাভাবিক হবে সেটি নিয়ে আশঙ্কা থাকে।’
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে বসবাস করেন শহিদুল ইসলাম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায়ই যৌথবাহিনী অভিযান চালায়। কিন্তু অপরাধ বন্ধ হয়নি। দেশের মধ্যে মনে হয় না এরকম আর কোনো এলাকা আছে। সবাই মিলেও কেন অপরাধীদের দমন করতে পারছে না? সামনে নির্বাচন, তখন সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেটি বুঝতে পারছি না।’
ঐতিহ্যগতভাবে অপরাধপ্রবণ এলাকা মোহাম্মদপুর
মোহাম্মদপুরে চারটি হটস্পটকে কেন্দ্র করে সক্রিয় রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী, কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসীরা। এই চার হটস্পট হচ্ছে- বসিলা বেড়িবাঁধ, ঢাকা উদ্যান, জেনেভা ক্যাম্প ও টাউন হলের বিপরীত পাশের বিহারি ক্যাম্প। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটে এসব এলাকার বাসিন্দাদের। সন্ধ্যা নামতেই থমথমে হয়ে যায় এলাকার সড়কগুলো।
মোহাম্মদপুরকে ঐতিহ্যগতভাবে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করেন পুলিশ ও র্যাবের অনেক কর্মকর্তা। তাদের মতে, এই এলাকায় মূলত কয়টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। যদিও সেগুলোর নির্দিষ্ট তালিকা নেই। তবে কিশোর গ্যাং ‘টিন এজ টর্নেডো’, ‘ডার্ক স্ট্রাইকার্স’, ‘রেড ভলক্যানো’ও ‘কবজি কাটা আনোয়ার’গ্রুপ প্রভাব বিস্তারে মরিয়া। আর এসব গ্রুপ লিডারদের গ্রেফতার করা হলে তাদের অধীনস্তরা আলাদা আলাদাভাবে আরও কয়েকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ তৈরি করে। আবার গ্রেফতারের কয়েকমাস পর আইনের ফাঁক-ফোকর গলে জামিন বেরিয়ে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আর এ কারণেই ওই এলাকায় বার বার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
রাজধানীতে অপরাধের পরিকল্পনা হয় মোহাম্মদপুরে
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগই পরিকল্পনা হয় মোহাম্মদপুরে। গত ৩ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের সেনপাড়া এলাকার আল-হেলাল হাসপাতালের সামনে আলিফ পরিবহণে অস্ত্রধারী কয়েকজন অগ্নিসংযোগ ও গুলির ঘটনা ঘটায়। আর এই ঘটনার পরিকল্পনা করা হয় মোহাম্মদপুরে। কিশোর গ্যাং লিডার পিচ্চি পিন্টুর নেতৃত্বে এটি করা হয় বলে জানিয়েছে বাসটিতে গুলি করা গ্রেফতার মো. নেছার উদ্দিন।
এছাড়া, সরকারপতনের আন্দোলন দমন করার জন্য এই এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে অনেক অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল, যার বেশির ভাগ এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেই অস্ত্রগুলো দিয়ে এখন অপরাধীরা তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এমনকি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ঝটিকা মিছিল ও ককটেল বিস্ফোরণের মাধ্যমে রাজধানীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির পরিকল্পনার বেশির ভাগই মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকা থেকে করা হয় বলে জানা গেছে।
মোহাম্মদপুর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে তারা কি সক্ষম?
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছি। ডিএমপির প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের নির্বাচনি সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। জানুয়ারির মধ্যে সবাইকে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্তমান যে পরিবেশ আছে, তার চেয়ে সামনে আরও উন্নতি হবে এবং নির্বাচনের জন্য সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকবে। মোহাম্মদপুরকে কেন্দ্র করে দুয়েকটি ঘটনা ঘটছে। সেসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলো নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, চাপাতি দিয়ে কোপাকুপি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শক্তি প্রদর্শন চলছিল। পরবর্তী সময়ে পুলিশ গুছিয়ে উঠে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। এর পর থেকে ঘটনাগুলো অনেকটাই কমেছে। মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় ধারাবাহিক অভিযানে অনেক চিহ্নিত ও নতুন অপরাধীদের আমরা আইনের আওতায় আনতে পেরেছি। বর্তমানে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আছে। এখন চুরি, ছিনতাই ও শক্তি প্রদর্শনের মহড়া নেই বললেই চলে। এখানে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টে কোনো সুজোগ দেওয়া হবে না।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কি না?- এমন প্রশ্ন করা হলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবশ্যই পারবে, পারবে না কেন? জুলাই আন্দোলনের পর থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। তারা এখন অনেক সাবলীলভাবে কাজ করছে। কিছু সমস্যা যদিও এখনো রয়ে গেছে। আশা করছি, আমরা এগুলো নির্বাচনের আগেই সমাধান করতে পারব। নির্বাচনের জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার সেগুলো নেওয়া হচ্ছে। আমাদের সবগুলো ইউনিটে সমন্বিত ট্রেনিং নিচ্ছে। টাস্ক ফোর্স সেল গঠন করা হবে, ওখান থেকে মনিটর করা হবে। তাই আশা করি সমস্যা হবে না, সম্পূর্ণ কন্ট্রোলে থাকবে।’
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক্ষেত্রে দুইটা দিক আছে। প্রথমত, সারা বছর ধরে যে অপরাধ কর্মকাণ্ড, এটা কিন্তু বিজনেসের একটা অংশ। যেমন- মাদক ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, দখলদারিত্ব প্রত্যেকটার সঙ্গে কিন্তু ফাইন্যান্সিয়াল ইমপ্লিকেশন আছে। এটা কিন্তু ক্লক রাউন্ডার, চলতে থাকে। দ্বিতীয়ত, যখন নির্বাচনের সময় আসে তখন সারা বছর ধরে রাউন্ড ক্লক ধরে যে বিজনেস চলে, সেটা কিন্তু আর সেই পর্যায়ে থাকে না। নির্বাচনের এজেন্ডাই ডিফারেন্ট। যখন নির্বাচনের কথা বলি, তখন সব হবে জয়েন্ট ইফোর্ট। তখন সব আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নির্বাচনের আগে থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় পুরো সময়টা মাঠে থাকবে। সবাই মিলে একত্রে কাজ করবে। তখনকার প্রেক্ষাপট কিন্তু ভিন্ন।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবার কাজ কিন্তু আলাদা করা থাকে। কে কেন্দ্রে কাজ করবে, কে কেন্দ্রের বাইরে থাকবে, কে পোলিং এজেন্টের সঙ্গে কাজ করবে, কে ওভারঅল শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কাজ করবে- এরকম কিন্তু এফোর্ট থাকে। নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের পক্ষ থেকে আমরা দিকনির্দেশনা পাচ্ছি। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী এবারের নির্বাচনটা যেন শৃঙ্খলা বজায় রেখে মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে ভোট কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে পারে। গত একবছরে র্যাব যে পরিমান ভালো কাজ করেছে, আলহামদুলিল্লাহ। আমরা সেনাবাহিনী ও পুলিশকে নিয়ে প্রতিটি এলাকায় কন্টিনিউ অপারেশন করছি। যাতে আইন-শৃঙ্খলা আয়ত্তের বাইরে চলে না যায়। র্যাবের ৯ হাজার সদস্য আছে। যখন প্রয়োজন হবে তারা নিয়োজিত থাকবে, ইনশাল্লাহ। অবশ্যই নির্বাচন শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে হবে।’
যা বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোহাম্মদপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তারা ওখানে শতভাগ ব্যর্থ। মোহাম্মদপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোটা দাগে কোনো ফলাফল তৈরি করতে পারেনি। কারণ, অপরাধ পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সারাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু অনেক প্রার্থী আছেন যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে জয়ী হতে চান। কালো টাকার প্রভাব, পেশি শক্তির প্রভাব, কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত সহিংসতা, অবৈধ ও বৈধ অস্ত্রের ব্যবহার- এই প্রসঙ্গগুলো তো আছেই। সেইসঙ্গে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের ৩০ শতাংশ এখনো উদ্ধার হয়নি। এই বিষয়গুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তার অগ্রগতির প্রশ্নে নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধীর কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে। এই ব্যবস্থাগুলো নির্বাচনের ওপরে প্রভাব বিস্তার করবে। আইনশৃঙ্খলা বর্তমানে যতটুকু কাজ করতে পারছে, এর রেশ যদি নির্বাচন পর্যন্ত চলতে থাকে, তখন এটা দিয়ে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।’
তদন্তে জানা যায়, প্রতিটি চক্রের পেছনে রাজনৈতিক ছায়া বা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যাকআপ থাকে। এটি প্রকাশ করতেও ভয় পায় সাধারণ মানুষ। এজন্য নিয়মিত অভিযানেও স্থায়ী পরিবর্তন আসে না। নিরাপত্তাবাহিনী আরও সমন্বিত উদ্যোগ নিলে নির্বাচন শুধু শান্তিপূর্ণ নয়, আস্থার প্রতীক হবে। সেজন্য শুধু অভিযান নয়, প্রয়োজন নিরাপত্তার স্থায়ী কাঠামো। তবেই নির্বাচন নিরাপদ হবে বলে ধারণা সাধারণ মানুষের।