রংপুর: উত্তরবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতীক—রংপুরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ। শতবর্ষ পেরিয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ ধুঁকছে অবহেলা, শিক্ষক সংকট, ভবনের ভগ্নদশা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায়। ১০৯ বছরের ঐতিহ্য বয়ে চলা এই প্রতিষ্ঠান একসময় ছিল উত্তরাঞ্চলের গর্ব, আজ অবহেলা এবং শিক্ষক সংকটে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রমকে স্থবির হয়ে পড়েছে।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ১৮টি বিভাগে শিক্ষকের পদ রয়েছে ১৮৩টি, অথচ কর্মরত মাত্র ১৬৫ জন। প্রতি ১৫১ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক—এমন বাস্তবতায় নিয়মিত ক্লাস চালানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ৬০ শতাংশ ক্লাস বাধ্যতামূলক হলেও তা পূরণ করা যাচ্ছে না।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষক সংকটের কারণে নিয়মিত ক্লাস বন্ধ থাকে, ফলে তারা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়াশোনার ওপর নির্ভর করছেন। এর ফলে অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাপ পড়ছে পরিবারগুলোর ওপর।
উত্তরাঞ্চলের বাতিঘরখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, উচ্চমাধ্যমিক এবং ডিগ্রি (পাস কোর্স) মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী ২৫ হাজারের বেশি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কলেজের পাঁচটি অ্যাকাডেমিক ভবনের মধ্যে তিনটি ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। শ্রেণিকক্ষে নেই পর্যাপ্ত আলো, ফ্যান কিংবা বেঞ্চ। প্রয়োজন ১৫০টি শ্রেণিকক্ষের; তার বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৯৩টি।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বিভাগে মাত্র তিনটি শ্রেণিকক্ষ। ক্লাস চলাকালীন অন্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে থাকেন।’
আবাসন সংকটও তীব্র। ছাত্রদের চারটি এবং ছাত্রীদের চারটি হল রয়েছে; যার মধ্যে জিএল (গোপাল লাল রায়), কেবি (কাশিম বাজার) ও নবনির্মিত আবু সাঈদ হলে ৩২৮ ছাত্রের আবাসন সুবিধা রয়েছে। কিন্তু ওসমানী হল ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ বলে পরিত্যক্ত। অন্যদিকে জাহানারা ইমাম, বেগম রোকেয়া, তাপসী রাবেয়া ও বীর প্রতীক তারামন বিবি হলে ৮৯৮ ছাত্রী থাকছেন। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রী মিলে মোট ১২২৬ জনের আবাসন সুবিধা যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ৫ শতাংশের মতো আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন। ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মেস বা ভাড়া বাসায় থাকেন, যা নিরাপত্তাহীনতা এবং অতিরিক্ত খরচের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারমাইকেল কলেজ ও আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে নগরের খামার মোড়, লালবাগ, পার্কের মোড়, কলেজপাড়া, দর্শনা ও মডার্নে কয়েক শ ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস গড়ে উঠেছে। কয়েকটি মেসে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, থাকা-খাওয়া ও মানসম্মত পরিবেশের অভাব রয়েছে। মানহীন মেসে থাকেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন মেসে থাকছেন, এমন অন্তত ১০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব মানহীন মেসে থাকা–খাওয়ায় বেশি খরচ হচ্ছে। যাতায়াতে বেশি সময় লাগে। নিরাপত্তাহীনতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কথাও জানান তারা। লালবাগের একটি মেসে থাকা শিক্ষার্থী হাসান আলী বলেন, মাসিক খরচ সাড়ে তিন হাজার টাকা, যা হলে থাকলে কম হতো।
শিক্ষার্থীরা জানান, গত জুন মাসে শিক্ষার্থীরা ৩৭ দফা দাবিতে টানা আন্দোলন করেন, যাতে ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত, রেলপথ অবরোধ এবং অডিটরিয়াম, হল নির্মাণ, শিক্ষক নিয়োগের দাবি ছিল। এছাড়া হলে বহিরাগতদের হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে, যাতে ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। কলেজ প্রশাসন জুলাই মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিবের সঙ্গে মতবিনিময় করে, যাতে কিছু ছোট দাবি পূরণ হয়েছে, কিন্তু বড় সমস্যাগুলো এখনও অমীমাংসিত।
কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে রংপুরের চতরা ডিগ্রী কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক মো. হারুন অর রশিদ চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে স্পষ্ট, কলেজের উন্নয়নে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন, যাতে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান তার গৌরব ফিরে পায়।
অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন পদ সৃষ্টির জন্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর শিক্ষক ডি এন মল্লিক কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। সন্জীদা খাতুন অধ্যাপনা করেছেন বাংলা বিভাগে। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী এ কলেজে পড়ালেখা করেছেন। শহীদজননী জাহানারা ইমাম, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক কারমাইকেল কলেজের ছাত্র। বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম স্পিকার শাহ্ আবদুল হামিদ, সাবেক সেনাপ্রধান মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং প্রথম প্রধান বিচারপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর কারমাইকেল কলেজেরই ছাত্র।