Wednesday 22 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লুট হচ্ছে শত কোটি টাকার বালু, প্রশাসন নির্বিকার

আল হাবিব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২২ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:৫৬ | আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:০৯

ড্রেজার ও বোমা মেশিন ব্যবহার করে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। ছবি: সারাবাংলা

সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জের ধোপাজান নদীতে ভিটবালু নাম করে লুক করা হচ্ছে সিলিকা বালু। আর ধোপাজান নদীর বুক চিরে চলছে ড্রেজার ও বোমা মেশিন। এসব ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নদীর প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও স্থানীয়দের জীবন-জীবিকার সুরক্ষায় বালু উত্তোলন বন্ধ রেখেছেন আদালত। সেই ড্রেজার, বোমা মেশিন ব্যবহার করে ইজারাবিহীন চলতি নদী থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। যদিও এক বছরের জন্য এক কোটি ২১ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)। বিনিময়ে সরকার রাজস্ব পেয়েছে মাত্র এক কোটি টাকা। আর ভিটি মাটি উত্তোলনের এই অনুমতি নিয়ে লুট করা হচ্ছে শত কোটি টাকার উন্নতমানের সিলিকন বালু, যার মালিক খনিজ সম্পদ বিভাগ। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানালেও কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় নির্বাক প্রশাসন।

বিজ্ঞাপন

মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা চলতি নদীজুড়েই বৃহৎ বালুমিশ্রিত পাথর কোয়ারি ধোপাজান। স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা আর পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে ২০১৮ সালে কোয়ারি থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে আদেশ দেন আদালত। সাত বছর বালু উত্তোলন বন্ধ থাকার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর শুরু হয় হরিলুট। লুট বন্ধ না করে উল্টো প্রশ্রয় দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে প্রত্যাহার হন তৎকালীন এসপি আনোয়ার হোসেন। এরপর প্রশাসন তৎপর হলে ফের বন্ধ হয় বালু উত্তোলন।

তবে বালুমহালে উত্তোলন বন্ধ থাকলেও সরকারি সিদ্ধান্তে কয়েকদিন ধরে নদীতে চলছে বালু উত্তোলন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মাত্র এক কোটি টাকা রাজস্বের বিপরীতে এক কোটি ২১ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এরপর থেকেই নদীর একাধিক স্থানে পরিবেশ বিধ্বংসী ড্রেজার আর বোমা মেশিনের তাণ্ডব চালাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং। অনুমতি দেওয়ার পর থেকেই নিজেদের বসতভিটা, ফসলি জমি, বাঁধ, কবরস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ নানা স্থাপনা বাঁচাতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন স্থানীয়রা।

উরার কান্দার ফারুক মিয়া বললেন, ‘প্রত্যেকদিন ড্রেজার আর বোমা দিয়া বালু তোলে। আমরা বাঁধা দিলেও মানে না। এমনিতেই নদীর পাড়ের ঘর আমাদের। সব সময় ঝুঁকিতে থাকে। এর মাঝে এসব মেশিন দিয়ে বালু তুললে আমরা ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসবো।’

আবু ইউসুফ বলেন, ‘সরকার যদি এভাবে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়। তাহলে আমাদের ঘরবাড়ি কিনে নিয়ে আমাদের অন্য এলাকায় বসতি করে দিক। আমরা সেখানে চলে যাই।’

উরার কান্দা জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘এভাবে বালু তোলা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের ভেতরে মসজিদ, মসজিদের সামনে স্কুল, কবরস্থান, রাস্তাঘাট সব বিলীন হবে। আমরা চেয়ে দেখতেছি শুধু। এতো জায়গায় যাচ্ছে আমাদের গ্রামের মানুষ, এসব বন্ধ করার জন্য তবুও কোনো সাড়া মিলছে না।’

তকদিল মিয়া বলেন, ‘একসঙ্গে কয়েক হাজার মানুষ ঘরছাড়া হওয়ার শঙ্কায় আছি। এরপর আমরা বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে হাত পাতা ছাড়া আর উপায় দেখছি না।’

সরেজমিনে চলতি নদীতে মনিপুরী ঘাট পার হতেই দেখা মিলল একের পর এক বাল্কহেড লোড হচ্ছে। বিকট শব্দে চলছে দুটি বোমা মেশিন, একটি ড্রেজার মেশিন। ভিটি বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় দানার উন্নতমানের সিলিকা বালু। এগুলো যে ভিটি বালু নয় তা স্বীকারও করেন ড্রেজার শ্রমিকরা। তারা বলেন, ‘এই বালু দিয়ে যেকোনো কাজ করা যাবে।’

লিমপিডের টোকেনের দায়িত্বে থাকা এরশাদ বলেন, ‘আমাদের বালু, মাটি দুইটা উত্তোলনের অনুমতি আছে। এখানে ড্রেজার চালালে মাটির সঙ্গে বালু আসবেই। দুইটা মিলে ভিভি বালু হয়ে যায়।’

দিনে প্রকল্পের নামে বালু তোলা হলেও শর্ত ভেঙে রাতের আঁধারেও বালু বিক্রি করছে একটি মহল। এতে নির্দিষ্ট পরিমানের বাইরে, কয়েক গুণ বেশি বালু লুট হওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা।
হাওর ও নদী রক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক ওবায়দুল হক মিলন বলেন, ‘এই অনুমতির প্রক্রিয়াটাই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ চলতি নদীতে কোনেো ভিটি বালু নেই। যা আছে সব উন্নতমানের সিলিকা বালু। ঢাকা – সিলেট সড়কের আশেপাশে আরও অসংখ্য নদী আছে, যেখান থেকে বালু তোলা যাবে। সেখান থেকে না নিয়ে এতো দূর সীমান্তের কাছে এই চলতি নদী থেকে বালু উত্তোলনের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য আছে।’

শিশু সংগঠক রাজু আহমেদ বলেন, ‘বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে দিনে। তাহলে রাতে কারা বালু তুলছে। এখানে এক কোটি বালুর অনুমতি নিয়ে কয়েক কোটি বালু লুট করার পাঁয়তারা চলছে।‘

মাটির সঙ্গে বালু উত্তোলনের কথা শ্রমিক ও লিমপেডের লোকজন স্বীকার করলেও অস্বীকার করেন বালু উত্তোলনের অনুমতি প্রদানকারী বিআইডাব্লিউটিএ’র সিলেট আঞ্চলিক দফতরের উপ-পরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘খনিজ সম্পদ বিভাগের গেজেটভুক্ত জায়গার বাইরে থেকে শুধু ভিটি মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। আমি নিয়মিত পরিদর্শন করছি। আপনি যদি সরেজমিনে গিয়ে ব্যত্যয় পান রিপোর্ট করেন।’

খনিজ বিভাগের সম্পদ নেওয়ার অনুমতি বিআইডাব্লিউটিএ দিতে পারে কি-এমন প্রশ্ন শেষ করার আগেই মিটিং আছে বলে ফোন কেটে দেন। ৬ ঘন্টা পর ফের ফোন দিলে ফোনে কথা বলতে বাধ্য নন বলে জানান তিনি। যত বড় সাংবাদিক হউক তিনি কথা বলবেন না। তথ্যের প্রয়োজনে তথ্য অধিকারে চাইতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘বিআইডাব্লিউটিএর এই সিদ্ধান্ত পরিবেশ প্রকৃতি বিরোধী সিদ্ধান্ত। ধোপাজান নদীর বর্তমান যে অবস্থা সেই অবস্থায় এখান থেক কোনোভাবেই বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা না বলে একটি সরকারি সংস্থা কিভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিল সেটাই আমাদের কাছে বিস্ময়কর। আমরা জানার পর পরই চিঠি দিয়ে জানিয়েছি যে এখান থেকে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য।’

জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘ধোপাজান খনিজ বিভাগের মালিকানাধীন একটি সম্পদ। আমরা যখন জানতে পারি চলতি নদী থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তখনই পত্র দিয়ে বাস্তব অবস্থা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই। এরমধ্যে বালু উত্তোলন করলে নৌকাও আমরা জব্দ করি। এরপর লিমপিড আরেকটা সংশোধিত অনুমতিপত্র নিয়ে আসে। যেহেতু সরকারি একটা দপ্তর এই অনুমতি দিয়েছে তাই যাদের যাদের জানানোর দরকার চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। পরবর্তীতে তারা কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় আমরা কোন ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তবে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এই বিষয়ে অবগত আছে।’

সারাবাংলা/জিজি
বিজ্ঞাপন

বগুড়ায় গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার
২২ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর