Wednesday 22 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বদলে গেছে পররাষ্ট্রনীতি
ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবমুখীতাই মূলমন্ত্র, প্রাধান্য পারস্পরিক সহযোগিতার

অপূর্ব কুমার, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট
২২ অক্টোবর ২০২৫ ২১:২৯ | আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৫ ২১:৫০

ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমলে বদলে গেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ এমন একটি পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, যা ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবমুখী। যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে জাতীয় স্বার্থ ও পারস্পরিকতা অগ্রাধিকার। এতে একই সঙ্গে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক রক্ষা করা হয়েছে। যা অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক কৌশলে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।

কূটনীতিতে ড. ইউনূসের প্রভাব

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ‘এই সরকারের একটি সম্পদ’ কাজ করেছে। গত ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট সরকার গঠনের পরেই মাত্র একটি ফোন কলের মাধ্যমে প্রফেসর ইউনূস সংযুক্ত আরব আমিরাতে বন্দী অনেক বাংলাদেশির সাধারণ ক্ষমা নিশ্চিত করতে সহায়তা করেন। তার সুনাম পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এক অনন্য কূটনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে। এই ধরনের ‘সফট পাওয়ার’ কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক

বিগত সরকারের পতনের পর সবচেয়ে আলোচনার বিষয় ছিল ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ছন্দপতন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী কর্ম সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে। যদিও দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে শীতলতা কাটেনি। তারপরও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও পারস্পরিকতা ভিত্তিক একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সাম্প্রতিক বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা ও স্থলবন্দর সংক্রান্ত অমীমাংসিত বিষয় থাকলেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য এখনো চলমান রয়েছে। এছাড়া ভারতের দিকে ক্রস-বর্ডার কেনাকাটায় যাওয়া এবং চিকিৎসা ও পর্যটনের জন্য ভ্রমণ সীমাবদ্ধতা আছে। এখন আগের মতো মানুষ এখন আর ছোটখাটো চিকিৎসার জন্য ভারত যাচ্ছে না, বরং চীন ও থাইল্যান্ডের মতো দেশে যাচ্ছে, বিশেষত যেসব সেবা এখনো বাংলাদেশে নেই।

সীমান্তে হত্যা ও পুশ-ইন বিষয়ে জোরালো প্রতিবাদ

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর হাতে মানুষ হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ এরই মধ্যে আরও জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এসব ঘটনার বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নিন্দা জানিয়েছে। একাধিকবার ঢাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের কাছে উদ্বেগ তুলে ধরেছে বাংলাদেশ, যা আগে ঘটেনি। পাশাপাশি গত এক বছরে বর্তমান সরকার আগের সরকারের তুলনায় ভারতকে আরও কঠোর ভাষায় প্রতিবাদপত্র দিয়েছে, যা কূটনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে আরও দৃঢ়তা প্রকাশ করে। সরকার ভারতকে অনুরোধ করেছে যেন এ ধরনের ‘নৃশংস কর্মকাণ্ড’ আর যেন না ঘটে। প্রতিটি সীমান্ত হত্যার ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ বলেছে, যারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, তাদের শনাক্ত করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সীমান্তে অনিয়মিতভাবে ‘পুশ-ইন’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারতীয় বাংলা ভাষাভাষী নাগরিকদেরও ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ভারতকে বলেছে, মানুষ ফেরত পাঠানোর জন্য একটি নির্ধারিত প্রক্রিয়া রয়েছে। আমরা সেই প্রক্রিয়া মেনেই লোক ফেরত পাঠিয়ে আসছি।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকরণ

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণে চেষ্টা করছে। বিগত সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক নাজুক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ, এমন কী পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা চালু করা হয়েছে। আরও বেশি যোগাযোগ বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে বিমান চালুর পরিকল্পনা আছে। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানের প্রতি কোনো ধরনের নীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত নেই। সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে নেওয়া, যাতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
তবে কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু ঢাকা এটি নাকচ করে বলেছে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা পায়। এই ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ হলো সামগ্রিকভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি রক্ষার অংশ। কারণ বিগত সরকার আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা’ হয়েছিল, যা ছিল অপ্রয়োজনীয়।

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক

১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব স্থিতিশীলই থেকেছে। বাংলাদেশে অনেক সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনো খারাপ হয়নি।’ সব সরকারের আমলেই ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যকার এই সম্পর্কের গভীর তা বেড়েছে। তবে কিছু মহলে বাংলাদেশ ‘চীনের খুব কাছাকাছি’ চলে যাচ্ছে বলে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হছে। তা সরকার নাকচ করেছে। কারণ ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আমাদের নিজেদের স্বার্থে আর অবশ্যই চীনেরও স্বার্থ রয়েছে। দুই দেশের সহযোগিতা একতরফা নয়; বরং এটি পারস্পরিক লাভ এবং অভিন্ন অগ্রাধিকারভিত্তিক। চলতি বছরে চীন-বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি পালিত হচ্ছে। চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য চীনের ভিসা সহজীকরণ, বাংলাদেশের চীনের অর্থ সহযোগিতায় হাসপাতাল নির্মাণ, চীনের অর্থায়নের তিস্তা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের আশ্বাসসহ নানাবিধ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরে দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস মিলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক

বিগত সরকারের আমলে প্রভাবশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের ঘাটতি ছিল। বিগত সরকার প্রধান বিভিন্ন ইস্যুতে অযাচিতভাবে মার্কিন সরকারকে নিয়ে বিব্রতকর সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যেও বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর না করাকে পছন্দ করলেও ঢাকা নিজের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দিকেই বেশি মনোযোগী, কোনো নির্দিষ্ট বলয়ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে আগ্রহী নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে, যদিও তাদের ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে এবং একইসঙ্গে চীনের ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও রয়েছে। এই জটিলতাই, তা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য বাস্তববাদী এবং স্বার্থভিত্তিক পররাষ্ট্র সম্পৃক্ততা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় ১৫ শতাংশ শুল্ক হ্রাসে বাংলাদেশের সাফল্যেই বড় উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। শুল্ক কমানো ছাড়াও নিরাপত্তাসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির অংশীদারিত্ব আগের তুলনায় বেড়েছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ওপর জোর

বিগত ৮ বছর ধরে বাংলাদেশ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১০ লাখেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেও অর্থবহ প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা এখনও দূরবর্তী। সেই কারণে বর্তমান সরকার প্রধানের নেতৃত্ব শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সঠিক প্রত্যাবাসনের জন্য চলতি বছরে কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের পাশাপাশি জাতিসংঘে পৃথক আলোচনার প্লাটফরম তৈরি সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, অন্তবর্তকালীন সরকারের আমলে বাংলাদেশ একটি পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, যা ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবমুখী। বাংলাদেশকেন্দ্রীক পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থ ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রাধান্য পেয়েছে। একইসঙ্গে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক রক্ষা করা হয়েছে।