ঢাকা: সন্ধ্যার আলোয় বাঁশের খুটখুট শব্দের সঙ্গে চলছে হলুদ রঙের সুতোয় জড়ানো কঠিন চীবর দানের পবিত্র চাদর তৈরির কাজ। যে চাদরে জড়িয়ে আছে ভক্তি, শ্রম আর গভীর সাধনা। বৌদ্ধ নারীসমাজ একাগ্র মনে বুনে চলেছেন কঠিন চীবর দানের ‘পবিত্র চাদর’ বা ‘গেরুয়া বস্ত্র’। কারণ, আজ (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় শুরু হওয়া এই চীবর, বুনন শেষ করতে হবে ভোরের সূর্য ওঠার আগেই।
রাজধানীর মিরপুরের পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ ও শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে চলছে এই ভিন্ন আবহ। শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) শুরু হবে বৌদ্ধদের কঠিন চীবর দান উৎসব–২০২৫।
হাজার বছরের ঐতিহ্য
বুদ্ধের জীবদ্দশায় শুরু হয়েছিল এই অনন্য প্রথা। বর্ষাবাস শেষে, আশ্বিন বা কার্তিক মাসে (সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর), বৌদ্ধরা সন্ন্যাসীদের নতুন চীবর (বস্ত্র) দান করেন। ‘কঠিন’ শব্দটি এসেছে পালি শব্দ কঠিন থেকে, যার অর্থ মজবুত, দৃঢ়। এটি প্রতীকী অর্থে দৃঢ় বিশ্বাস ও ত্যাগের প্রতিরূপও বটে।
একদিনে চাদর তৈরি ও দানের আচার
কঠিন চীবর দান সাধারণ বস্ত্র দানের মতো নয়। এতে পুরো চীবরটি সুতো কাটার পর থেকে রং করা, সেলাই ও ভিক্ষুদের দান পর্যন্ত একই দিনে সম্পন্ন করতে হয়। রাতজুড়ে এই কর্মযজ্ঞ চলে এক পবিত্র উৎসবের মতো। বৌদ্ধ নারীরা হাসিমুখে তাঁতে বসেন, কেউ রং মেশান, কেউ সেলাই করেন, কেউ আবার ধ্যানমগ্নভাবে পারিতোষিক পাঠ করেন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় থাকে সমষ্টিগত অংশগ্রহণ- যা সমাজে ঐক্য, সহানুভূতি ও ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য প্রতীক।
সুতো বুনতে বুনতে সুচিত চাকমা নামে এক নারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাত্র একদিনে এই চীবর প্রস্তুত করাটা অনেক কঠিন ও ধৈর্যের কাজ। কিন্তু এই কাজের দায়িত্ব পাওয়াটাও কম ভাগ্যের নয়। আমরা তাই খুশি মনেই কাজটি করি। কারণ, আমরা মনে করি যে, আমাদের হাতে তৈরি কঠিন চীবরটি তৈরির মধ্যেও সৌভাগ্য জড়িত।’
ভক্তি ও ত্যাগের রঙে রাঙানো
চীবর বুননের প্রতিটি সুতোর সঙ্গে যুক্ত থাকে একেকজন নারীর প্রার্থনা— ‘এই চীবর যেন দানের আনন্দে পূর্ণ হয়, ত্যাগের আলোয় দীপ্ত হয়।’ এ যেন এক নিঃশব্দ সংলাপ নিজের ভেতরের অপবিত্রতা ত্যাগ করে শুদ্ধ চিত্তের পথে যাত্রা। অনেকে বিশ্বাস করেন, কঠিন চীবর দানে অংশ নিলে অতীত জীবনের পাপ মোচন হয়, মন হয় প্রশান্ত।

কঠিন চীবর দান উদযাপন কমিটির আহবায়ক শৈলজ বিকাশ চাকমা। ছবি: সারাবাংলা
উৎসবের সামাজিক তাৎপর্য
কঠিন চীবর দান শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সমাজকেন্দ্রিক একটি ঐতিহ্য। এই সময় বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে আয়োজন করা হয় ধর্মসভা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও ভিক্ষুদের ধর্মদেশনা। বিভিন্ন বয়সের মানুষ, শিশু থেকে প্রবীণ সবাই মিলিত হন এক পবিত্র মিলনমেলায়।
এ বিষয়ে কঠিন চীবর দান উদযাপন কমিটির আহবায়ক শৈলজ বিকাশ চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কঠিন চীবর দান শুধু ধর্মীয় আচার নয়। এটি এক অন্তর্লোকের যাত্রা, যেখানে মানুষ শেখে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পাঠ। এর দার্শনিক তাৎপর্য প্রধানত তিনটি- দানশীলতা, অহিংসা ও সামাজিক সংহতি। এই চীবরটি আমাদের ভিক্ষুকে দান করা হবে।’
তিনি জানান, এই প্রথার উৎপত্তি বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম যুগে, যখন ভিক্ষুরা বর্ষা-মৌসুমের পরে ভিক্ষার জন্য ভ্রমণ শুরু করতেন। বর্ষাকালে তারা বিশেষ আশ্রমে অবস্থান করতেন, যেখানে তারা নিজেদের আধ্যাত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করতেন। বর্ষা শেষে ভিক্ষুরা যখন বের হতেন, তখন স্থানীয় সম্প্রদায় তাদেরকে নতুন চীবর দান করত, যা তাদের পরিধানের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। এই প্রথা পরবর্তী সময়ে একটি নিয়মিত ধর্মীয় আচার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রাজধানীতেও পালিত হচ্ছে এ উৎসব
বাংলাদেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দান আগামীকাল শুক্রবার পালিত হবে। সাধারণত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে চলে বৌদ্ধদের এই আয়োজন। রাজধানীতে হাতে গোনা কয়েকটি বৌদ্ধ বিহারে চলে উৎসবটি। এ উপলক্ষ্যে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ ও শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে দুই দিনব্যাপী (২৩ ও ২৪ অক্টোবর) ৩৭তম কঠিন চীবর দান–২০২৫ অনুষ্ঠিত হবে।
শুক্রবার সকাল থেকে বিহারে শুরু হবে পূজা, প্রার্থনা, সংঘদান ও ধর্মীয় আলোচনা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভিক্ষু ও ভক্তরা এতে যোগ দেবেন। বৌদ্ধ বিহার সূত্রে জানা যায়, কঠিন চীবর দান উৎসব শুধু ভিক্ষুদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অনুষ্ঠান নয়, এটি দাতা ও উপাসকদের জন্যও একটি গভীর আত্মিক অনুশীলন ও পুণ্যলাভের সুযোগ। কাল এই কঠিন চীবর দানের বস্ত্রটি পরে ধ্যানে মগ্ণ হবেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।