সিলেট: ঐতিহ্য রক্ষায় অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। সিলেট নগরীর পাঠানটুলার ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যনন্দন ‘মিনিস্টার বাড়ি’ ভাঙার কাজ আগামী রোববার (২৬ অক্টোবর) পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর।
শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সকালে স্থাপনাটি পরিদর্শনে যান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গবেষণা সহকারি মো. ওমর ফারুক। তিনি পরিদর্শন শেষে জানান, স্থাপত্যটির ঐতিহাসিক মূল্যায়ন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে হবে।
ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি ভাঙার খবর গণমাধ্যমে না আসা পর্যন্ত বিষয়টি অনেকেরই অজানা ছিল।
তবে গত মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘সারাবাংলা’ এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে জানানো হয়—‘‘সিলেটের ঐতিহ্য একে একে বিলীন হচ্ছে, তারই অংশ হিসেবে হাতুড়ির আঘাতে মাটিচাপা পড়ছে ঐতিহাসিক ‘মিনিস্টার বাড়ি’।’’
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সচেতন নাগরিক, ইতিহাসবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও নগরবাসীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
সেখানে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে—এই স্থাপনাটি ভেঙে ফেলার আগে অন্তত এটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের বিবেচনায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে। সিলেট জেলা প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে প্রতিনিধি পাঠায়। ফলস্বরূপ, আজ সকালে ভাঙার কাজ স্থগিতের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি সিলেটের পাঠানটুলা এলাকার অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। ‘মিনিস্টার বাড়ি’ নামটি এসেছে অবিভক্ত ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদ-এর নামানুসারে।
দেশভাগের পর তিনিই পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুল হামিদ ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার পরিবারের শিকড় সিলেটের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আব্দুল হামিদের বোন হাফিজা বানু ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ-এর স্ত্রী। তারাই বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেনের দাদা-দাদী।
এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও এক ঐতিহাসিক অধ্যায়—পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একবার সিলেট সফরে এসে এই বাড়িতে বিশ্রাম নিয়েছিলেন বলে স্থানীয় প্রবীণরা জানান।
আব্দুল হামিদের চাচা মৌলভী আব্দুল করিম ছিলেন সিলেটের শিক্ষার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ। সমাজে তার অবদান ও দানশীলতার কারণে তাকে ‘সিলেটের মহসীন’ বলা হতো।
এই পরিবারের ইতিহাস কেবল একটি পরিবারের নয়, বরং এটি সিলেটের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সম্প্রতি বাড়িটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় মালিকপক্ষ নিজ উদ্যোগে ভাঙার কাজ শুরু করেন। তবে এর স্থাপত্যশৈলী, দৃষ্টিনন্দন নকশা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় বিষয়টি জানাজানি হতেই নগরবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
নগরবাসী ও স্থানীয় ইতিহাস গবেষকরা বলছেন, ‘যেভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, সিলেটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বিলীন হচ্ছে। এখনই সংরক্ষণ না করলে একদিন এই শহরের ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায়ই থাকবে।’
আজকের পরিদর্শনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা ভবনটির বয়স, নির্মাণশৈলী ও ঐতিহাসিক মূল্য যাচাই করে দেখছি। সংরক্ষণের উপযোগী মনে হলে ভবনটি জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।’
তিনি আরও জানান, ‘ভাঙা আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভবনের স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।’
আব্দুল হামিদের নাতি আনিসুল ইসলাম জানান, ‘বাড়িটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। তাই এই পুরনো বাড়িটি ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। এটি ভাঙতে আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে। তবে নিরূপায় হয়ে ভাঙতে হচ্ছে।’
স্থানীয়রা বলছেন, ‘সারাবাংলা’র প্রতিবেদন না হলে হয়তো এই বাড়ির অস্তিত্ব আজই মাটির নিচে চলে যেত।
প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব সিলেটের সমন্বয়ক সাদিকুর রহমান সাকী বলেন, ‘একটি মিডিয়া রিপোর্টই প্রশাসনকে নড়েচড়ে বসিয়েছে। এটা প্রমাণ করে—সংবাদমাধ্যম এখনো ঐতিহ্য ও নাগরিক স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিনিস্টার বাড়ি’ শুধু একটি পুরনো স্থাপনা নয়, এটি সিলেটের ইতিহাসের জীবন্ত অংশ। তাই এটি সংরক্ষণ করে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা জাদুঘর বা ঐতিহাসিক হেরিটেজ সেন্টার হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ ও গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা—এই দুইয়ের সমন্বয়েই হয়তো সিলেটের এই প্রাচীন ঐতিহ্যটি আপাতত ভাঙনের হাত থেকে বেঁচে গেল।