Saturday 25 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঠাকুরগাঁওয়ে ঘুষের বিনিময়ে দিনের পরীক্ষা রাতে

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:১৩ | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৮:০৪

অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওদুদ। ছবি: সারাবাংলা

ঠাকুরগাঁও: বিদ্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগে দিনের পরীক্ষা রাতে হতো। ঘুষের বিনিময়ে এমন ঘটনা ঘটেছে ঠাকুরগাঁওয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ভেলাতৈড় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওদুদ ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লা’র বিরুদ্ধে। এছাড়াও জাল সার্টিফিকেটে প্রধান শিক্ষক হওয়া, বিদ্যালয়ের অর্থ আত্নস্বাৎ ও কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম দূর্নীতিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, আব্দুল ওদুদ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৯ সালের শেষের দিকে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য ২০২৩ সালে কাগজ জটিলতায় বন্ধ থাকে। আবার সে বছরেই সবার অজান্তে কখন, কিভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত করে নেন, যা এখনো সকলের কাছে ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

২০২১ সালের নীতিমালা অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক হতে গেলে স্নাতক পাসের ক্ষেত্রে দুটিতে দ্বিতীয় বিভাগ থাকতে হবে। কিন্তু, আব্দুল ওদুদ স্নাতক পাস। তার শুধুমাত্র একটিতে দ্বিতীয় বিভাগ। তাহলে তিনি প্রধান শিক্ষক হলেন কিভাবে, আর এমপিওভুক্তই হলেন কিভাবে-এমন প্রশ্ন বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকসহ অনেকের মনে। তার নিয়োগ ও বেতন ভাতা সবই অবৈধ বলে উল্লেখ করেন তারা।

আব্দুল ওদুদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে আরও জানা যায়, বিদ্যালয়ে ল্যাব এসিসটেন্ট, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে তিনি ৫ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন। তিনি চাকরি দেওয়ার নাম করে আরেক ব্যক্তির কাছ থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এবং তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানন্নয়নে তার ভূমিকা নেই। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে রেখেছেন। বর্তমান উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লাহ প্রধান শিক্ষকের আত্নীয়। তার সহযোগিতায় এসব অপকর্ম করে আসছেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লাহ প্রায় পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে একই ষ্টেশনে চাকরি করে আসছেন। এর আগেও তিনি একই স্থানে দীর্ঘদিন চাকুরী করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে এসব করেছেন। আর এখন তিনি আরেকটি বড় দলের ছত্রছায়ায় থেকে দাপটের সঙ্গে এসব অপকর্ম করছেন।

বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করে আসছি। ওনার সার্টিফিকেট আমি জানি, আমার সার্টিফিকেট ওনি জানেন, ওনার চার পয়েন্ট হয় কিন্তু পাঁচ পয়েন্ট কিভাবে হলো-এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সহকারি শিক্ষক মনসুরা খাতুন বলেন, প্রধান শিক্ষক চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে এতো টাকা নিয়ে কি করলেন, বিদ্যালয়ের ফান্ডেও জমা করেননি। আবার সহকারি থেকে প্রধান হলেন এটাও জানতে পারলাম না।

আরেক সহকারি শিক্ষক বিনোদ চন্দ্র রায় বলেন, ‘যেদিন কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা, সেদিন হঠাৎ করে আমাকে বিকালে ডাকলো। আসার পরে সন্ধ্যার সময় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আসলেন। প্রধান শিক্ষক বললেন চলেন, কোথায় যেতে হবে ? শুধু বললেন ঠাকুরগাঁওয়ে। তখন আমি বললাম. ওখানে গিয়ে কি হবে ? বললেন, চলেন ওখানে গিয়ে বলবো। সভাপতির গাড়িতে করে ঠাকুরগাঁওয়ে গেলাম রাত তখন প্রায় ১০টা। একটা কনসেপ্ট স্কুলে নিয়ে গেলেন। সেখানে প্রার্থীদের নামমাত্র পরীক্ষা নিলেন। পাশে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের পাঁচ তলা বাসা। তিনি নিজেই বললেন এইটা আমার বাসা।’

সহকারি শিক্ষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা নেওয়া হয়। ডিও, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারসহ বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয়। এটা শুধু এখানে নয় পুরো বাংলাদেশের একই চিত্র। তবে এখানে স্বার্থে হয়তো কারো আঘাত লাগছে, কেউ হয়তো টাকার ভাগ পায়নি বা এক লাখ টাকা পেলে ভালো হতো। সে জন্য এগুলো করছে।’

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ মাহমুদ শাহরিয়ার জানান, ‘আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি এ বিষয়ে তেমন কিছু জানতাম না। প্রধান শিক্ষক একদিন আমাকে রাতের বেলা জানালেন ঠাকুরগাঁওয়ে যেতে হবে। নিয়ে গেলো ঠাকুরগাঁও শহরের ঘোষপাড়ায়, গিয়ে দেখি কেজি স্কুলে চারজন প্রার্থীর পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক নিজেই সব কিছু করেছেন।‘

ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের ঘোষ পাড়ায় অবস্থিত কনসেপ্ট স্কুলের (কেজি স্কুল) সভাপতি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লাহ। ১০-১৫ বছর ধরে সভাপতি আছেন। স্কুলচলাকালীন সময় কোনো পরীক্ষা হয়নি। তবে রাতের বেলা নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছিল কিনা এব্যাপারে কিছুই বলতে পারেননি কনসেপ্ট স্কুলের অধ্যক্ষ শামিম আরা বেগম।

ভেলাতৈড় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওদুদ অভিযোগের বিষয়ে জানান, ‘সহকারি শিক্ষকরা আমার কাছ থেকে সকলে টাকা নিয়েছেন। আমার কাছে সবকিছু লেখা আছে, কে কতো টাকা নিয়েছেন। আর কিছু বিষয় মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্রমূলক।’

পীরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লাহ বলেন, ‘আগের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে বর্তমান প্রধান শিক্ষকের মানসিক দ্বন্দ্ব আছে। এসব ছোটখাট অভিযোগ, দোষের কিছু নয়।’ আর দিনের পরীক্ষা রাতে হয়েছে এরকম কিছু জানা নেই বলে জানান তিনি।

তদন্তকারী কর্মকর্তা পীরগঞ্জ উপজেলা আইসিটি অফিসার সুমিত গুপ্ত জানান, ইতিমধ্যে ঘটনা তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। তদন্তকালে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে এমনটাই জানান তিনি। পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রকিবুল হাসান জানান, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে। অভিযোগ প্রমানিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সারাবাংলা/জিজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর