সিলেট: প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নির্দেশ উপেক্ষা করেই চলছে এতিহ্যবাহী ‘মিনিস্টার বাড়ি’ ভাঙার কাজ। নগরীর পাঠানটুলায় অবস্থিত শতবর্ষী এই বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে ফটকে তালা ঝুলিয়ে— যেন কেউ ঢুকতে না পারে, দেখতে না পারে ইতিহাসের অপমৃত্যু।
একসময় আসাম প্রদেশের শাসন আমলে নির্মিত এই বাড়িটি শুধু স্থাপত্যে নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ছিল অনন্য। ‘আসাম স্থাপত্যশৈলী’র নিদর্শন হিসেবে মিনিস্টার বাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের গর্বের জায়গা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একদল ব্যক্তি বাড়িটির ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো অনুমতি ছাড়াই তারা ভেতরে ঢুকে দরজা-জানালা ও কাঠের অবকাঠামো খুলে নিচ্ছে।
শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তারা ভাঙার কাজ সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেন। এ খবর বিভিন্ন গণমাধ্যম ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করে। কিন্তু শনিবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সেখানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নির্দেশ উপেক্ষা করে ফের ভাঙার কাজ চলছে। ভাঙার দায়িত্বে থাকা ভাঙারি ব্যবসায়ী মহরম আলী জানান, তিনি বাড়িটি ভাঙার জন্য ভাঙারির দরে ১৮ লাখ টাকায় কিনেছেন। সম্পূর্ণ ভাঙতে অন্তত দুই মাস সময় লাগবে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের গবেষণা সহকারী মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। প্রাথমিকভাবে ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।’ এ ঘটনায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সিলেট অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত গবেষণা সহকারী মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিয়ে জানান, ‘আপনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কুমিল্লা অঞ্চলের ওয়েবসাইটে গিয়ে আমার ঊর্ধ্বতনের ফোন নম্বর নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলুন।’
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, তার নির্দেশে সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ রাখার পরও মিনিস্টার বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে। এ ব্যাপারে ফের তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তিনি বিষয়টি নিয়ে ‘প্রভাবিত’ হয়ে পড়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে আসাম সরকারের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার আবাস হিসেবে ‘মিনিস্টার বাড়ি’ নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও সামাজিক মিলনস্থল হয়ে ওঠে। বাড়িটির কাঠের ছাদ, কলাম ও খোদাই করা দরজা-জানালা এখনো বহন করছে পুরনো দিনের স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য।

ঐতিহ্যবাহী মিনিস্টার বাড়ি রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন
এদিকে ঐতিহ্যবাহী ‘মিনিস্টার বাড়ি’ রক্ষার দাবিতে এদিন দুপুর ১২ টার দিকে মানববন্ধন করেছে পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট সিলেট। মানববন্ধন থেকে তারা বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি জানান। এতে পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্টের সদস্য, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা একমত পোষণ করেন, মিনিস্টার বাড়ি শুধুই একটি ভবন নয়, এটি সিলেট অঞ্চলের আসাম আমলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবন্ত দলিল।
বক্তারা সরকারের প্রতি অবিলম্বে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। সিলেটের সচেতন মহল আশা করছেন, এই মানববন্ধন এবং জনসচেতনতার প্রভাবেই সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ করবে এবং সিলেটে আসাম আমলের এই গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনটি সংরক্ষিত থাকবে।
মানববন্ধনে উপস্থিত কবি ইশরাক জাহান জেলি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাড়িটা শুধু ইট-পাথরের না, এটি সিলেটের ইতিহাস। মিনিস্টার বাড়ির ধ্বংস মানে আমাদের স্থাপত্য ঐতিহ্যের ধ্বংস। আমরা চাই এটি সংরক্ষণ করা হোক। সরকার ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
নগরবাসীর দাবি, দ্রুত বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে সিলেট আরেকটি ঐতিহাসিক সম্পদ হারাবে।