রংপুর: বিভাগীয় জেলা রংপুরে ১৫ বছর ধরে পরিবেশ আদালত স্থাপন না হওয়ায় দূষণকারীদের বিচার বিলম্ব হচ্ছে। ফলে বায়ু, পানি, মাটি ও শব্দদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। শুকনো মৌসুমে বায়ুমান পরীক্ষায় রংপুর প্রায়ই দূষিত বায়ুর শীর্ষে অবস্থান করে, যা স্থানীয়দের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ আদালত না থাকায় ৫০ লাখেরও বেশি গ্রাহককে ঢাকায় ছুটতে হয়, যা অর্থনৈতিক ও মানসিক ভোগান্তি বাড়িয়েছে। সচেতন মহলের দাবি, অবিলম্বে এই দুই আদালত স্থাপন করে সরকার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করুক।
সরকার ২০১০ সালের ১৯ জুলাই প্রতি জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিল, সঙ্গে ‘পরিবেশ আদালত আইন-২০১০’ অনুমোদন করে আইন লঙ্ঘনকারীদের পাঁচ বছরের সাজা ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখেছিল। কিন্তু ১৫ বছর পার হয়ে গেলেও রংপুরে এই আদালত গঠিত হয়নি। ফলে, পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। মামলাগুলো চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে চলছে, যেখানে মামলার চাপে নিষ্পত্তি বিলম্বিত হচ্ছে।
এদিকে বায়ু দূষণ নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু প্রতিবেদন মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের প্রতিবেদনে বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণজনিত কারণে ২ লাখ ৭১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন, যার ৯০ শতাংশ হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, ডায়াবেটিস ও ডিমেনশিয়ার মতো অসংক্রামক রোগসম্পর্কিত। এসওজিএর প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ সর্বোচ্চ বায়ু দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে, যেখানে সূক্ষ্ম কণা দূষণ (পিএম২.৫) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান ছাড়িয়ে যায়।
জানা গেছে, রংপুরে নগরায়ণের ফলে শব্দদূষণও বেড়েছে; স্কুল-হাসপাতালের নীরব এলাকায় মাইকের ব্যবহার কমছেই না। নগরীর বিকন মোড়ের বাসিন্দা রাতু রুমানা চৌধুরী স্নেহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রংপুরে আগের তুলনায় দূষণ বেড়ে গেছে।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ মাহামুদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোবাইল আদালত নয়, পরিবেশ আদালতের মাধ্যমে কঠোর পদক্ষেপ দরকার। কিন্তু পরিবেশ আদালত না থাকায় হয়রানি বন্ধ হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘দেশব্যাপী চিত্রও হতাশাজনক। বাংলাদেশে মাত্র দু’টি পরিবেশ আদালত রয়েছে, যা ১৭ কোটি মানুষের জন্য অপ্রতুল। ৬৪ জেলায় আদালত স্থাপন দরকার, যাতে জলবায়ুজনিত দূষণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়।’
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ডপসের প্রধান নির্বাহী উজ্জ্বল চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবেশ আদালত ছাড়া অন্য আদালতে মামলা চালাতে নানা বাধা, উচ্চ আদালতে যেতে হয় ঢাকায়, যা বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি করে। রংপুরে আদালত হলে বিচার সহজ হবে।’
মানবাধিকার ও পরিবেশ-মাপার প্রধান নির্বাহী আইনজীবী এএএম মুনীর চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্যামাসুন্দরী খালে ময়লা-মেডিকেল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে প্রভাবশালীদের দ্বারা। অবৈধ ইটভাটা বাড়ছে, যা পরিবেশের ক্ষতি করছে। পরিবেশ আদালত ছাড়া এগুলো রোধ কঠিন।’
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক নুর আলম সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানান, ‘মামলাগুলো চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চলছে। কিন্তু পরিবেশ আদালত হলে দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান রিপন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই অভাব শুধু আইনি নয়, নাগরিকদের জীবন প্রভাবিত করছে। সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হলে ন্যায়বিচার দূরের স্বপ্ন হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে পরিবেশ আদালতের সংখ্যা কম। ফলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ কঠিন। সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি ওঠাতে হবে সর্বত্র।’
পরিবেশের পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতেও একই সমস্যা। বিদ্যুৎ আদালতের অভাব যেন মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। রংপুর বিভাগে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৫০ লাখ গ্রাহক, কিন্তু বিদ্যুৎ আদালত নেই। বকেয়া বিল বা অবৈধ সংযোগের মামলা নিষ্পত্তির জন্য গ্রাহকদের ঢাকায় যেতে হয়।
গত একবছরে শুধু রংপুরের গঙ্গাচড়া জোনে ১৪৩টি মামলা হয়েছে, আর বিভাগে মোট ২৫ হাজার মামলা চলমান। তেমনই একজন ভুক্তভোগী গঙ্গাচড়ার খাদিমুজ্জামান সাজিদ। তার বিরুদ্ধে ৭০ হাজার টাকা বকেয়ার মামলা। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দুইবার ঢাকায় যেতে ৩০ হাজার খরচ হয়েছে। শারীরিক-মানসিক কষ্ট অসহ্য।’ আর শাওন মিয়ার ১১ হাজার টাকার মামলায় খরচ দ্বিগুণ।
রংপুর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আইনজীবী পলাশ কান্তি নাগ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিভাগীয় আদালত স্থাপন জরুরি, যাতে হয়রানি কমে সেবার মান বাড়ে।’ আর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার খুরশীদ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আদালত হলে উভয়পক্ষের লাভ।’
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ মাহামুদুল হক বলেন, ‘দেশে বিদ্যুৎসংক্রান্ত অপরাধের জন্য মাত্র ১৯টি আদালত, ৬৪ জেলার জন্য যা অপ্রতুল। পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের ২১ জেলায় আটটি আদালত। কিন্তু ১৩টি আরও দরকার।’ আদালতের অভাবে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হচ্ছে বলে দাবি তার।