চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় ১২ বছর কারাভোগের পর মুক্ত হওয়া যুবদল কর্মীকে খুনের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নিহত আলম তাকে খুন করার জন্য একটি গোষ্ঠীর নেওয়া পরিকল্পনা ঘটনার কিছুদিন আগে জেনে ফেলেছিলেন- এসংক্রান্ত ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই ভিডিওকে সূত্র ধরেই খুনিদের শনাক্তের চেষ্টা করছে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, আট অস্ত্রধারীর ‘কিলিং স্কোয়াড’ আলমকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে চার-পাঁচজনকে পুলিশ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে। ফেসবুকের ভিডিওতে আলম তার সম্ভাব্য হত্যাকারী হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করতে শোনা গেছে, তারা সেই আটজনের মধ্যে আছে কী না যাচাই-বাছাই করে দেখছে পুলিশ। তবে তদন্তের স্বার্থে শনাক্ত কারও নাম পুলিশ প্রকাশ করছে না।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এ ঘটনায় এখনো মামলাও হয়নি। শনিবার (২৫ অক্টোবর) বিকেলে রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চারাবটতল এলাকার রশিদারপাড়া সড়কে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে নিজ বাড়ির অদূরে গুলি করে যুবদল কর্মী মুহাম্মদ আলমগীর (৫০) ওরফে আলমকে খুন করা হয়। আলম রশিদারপাড়া এলাকার আব্দুস সাত্তারের ছেলে।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, শনিবার দুপুরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিজ বাড়ির কাছাকাছি এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন আলম। সেখান থেকে তিনি মোটরসাইকেল চালিয়ে ফিরছিলেন। রশিদারপাড়া মসজিদের সামনে দেওয়ালঘেরা একটি কবরস্থানে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা একদল দুর্বৃত্ত তাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তার শরীরে পাঁচটি বুলেটের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
রাউজান থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আটজনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ কবরস্থানের ভেতরে আলমকে হত্যার মিশন নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজনকে আমরা শনাক্ত করেছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা আপাতত নামগুলো প্রকাশ করছি না।’ নিজ দলের ভেতরে অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে আলমকে খুন করার বিষয়টিকে মাথায় রেখেই আপাতত তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানান ওসি।
নিহত আলম চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলের ১২ বছরই তিনি কারাগারে ছিলেন। অস্ত্র-মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় জেল খেটে তিনি ৯ মাস আগে জেল থেকে মুক্ত হন। মামলাগুলো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিমের রোষানলের কারণে দায়ের হয়েছিল বলে দাবি বিএনপি নেতাদের।
জেল থেকে বের হওয়ার পর আলম নিজ এলাকায় ফিরতে পারলেও নিজ দলের প্রতিপক্ষের বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এসংক্রান্ত একটি ভিডিওতে তাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মোবাইলে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি যে শোডাউন করিয়েছ আতঙ্ক সৃষ্টি করে, আমাকে তো মেরেও ফেলতে পারত, তুমি তো ও রকম মানুষ নিয়ে এসে আমাকে মেরে ফেলতে পার।…আমাকে তাড়ানোর জন্য তুমি এসব করছ।…ওরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে আমাকে থ্রেট দিতে।’
উদ্বিগ্ন আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি বাঁচতে চাই। ১৭ বছর আমি স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে কারাগারে ছিলাম। এখনো যদি তোমাদের কারণে কষ্টে থাকি, আমি কার কাছে যাব। আমাকে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। তাদের অস্ত্রসহ কেন আনলে। তিনটি মোটরসাইকেলে অস্ত্র ছিল।…আমি তো একলা ছিলাম। জনগণ পাশে আসায় ওরা চলে গেছে। নইলে তো আমার মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল। আমি তো নিরস্ত্র। আমরা তো অস্ত্রের রাজনীতি করি না। আমাকে আইনের আশ্রয় নিতে হবে।’
কথোপকথনের ভিডিও প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওসি মনিরুল বলেন, ‘সেখানে কয়েকজনের নাম শোনা গেছে। আমরা যাদের শনাক্ত করেছি, তাদের মধ্যে এই নামের কেউ আছে কী না অথবা যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা আদৌ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কী না সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে।’
নিহত আলমের স্ত্রী লাভলী আক্তার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গ্রুপিংয়ের কারণে আমার স্বামীকে অনেকবার খুন করার জন্য থ্রেট দেওয়া হয়েছিল। শেষপর্যন্ত মেরেই ফেলল। ভিডিওতে উনি যাদের নাম বলেছেন, তারাই এই খুনের সঙ্গে জড়িত। পুলিশ তাদের খুঁজে বের করুক। যারা আমার সন্তানদের এতিম করেছে, আমাকে বিধবা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।’
আলমের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে রোববার (২৬ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে নিজ বাড়িতে নেওয়া হয়। লাশ দাফনের পর স্বজনেরা মামলা করার জন্য থানায় যাবেন বলে জানিয়েছেন ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাউজানে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে, যার অধিকাংশই বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সংঘটিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাউজানের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে বিএনপি নেতাকর্মীরা এলাকাছাড়া ছিলেন।
কিন্তু সরকার পতনের পর রাউজানে ফেরা বিএনপির নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একভাগে আছেন গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীরা এবং আরেকভাগে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীরা। দুই নেতাই সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী।