Monday 27 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নাটোরে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা
জীবনরক্ষাকারী ইনজেকশনের আড়ালে ভয়ংকর মাদক ব্যবসা

শরিফুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৭ অক্টোবর ২০২৫ ০১:৪৮ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৫ ১০:২১

ভয়ংকর মাদক পেথিডিন ইনজেকশন ও মরফিন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

নাটোর: নাটোরে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের আড়ালেই চলছে ভয়ংকর মাদক ব্যবসা। চিকিৎসার প্রয়োজনে ব্যবহৃত পেথিডিন ইনজেকশন ও মরফিন ট্যাবলেট ব্যবহৃত হলেও এই শক্তিশালী ওষুধ মাদক হিসেবে এখন সহজলভ্যভাবে মিলছে শহরের বিভিন্ন ফার্মেসিতে। আর এই সহজলভ্য তাই তরুণ সমাজকে টেনে নিচ্ছে মৃত্যু ও অপরাধের দিকে।

যদিও এই ইনজেকশন সিভিল সার্জনের অনুমোদন ও ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ, কিন্তু ওষুধ ফার্মেসির আড়ালে অবাধে চলছে বেচাকেনা।

নাটোর শহরের আধুনিক সদর হাসপাতাল সড়কের নাহার ফার্মেসি। বাহ্যিকভাবে ছোট ও জরাজীর্ণ একটি দোকান— কিন্তু ভেতরে জমজমাট মাদক ব্যবসা। ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী পিন্টু, পিন্টুর ভাই নাটোর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ার সুবাদে ভাইয়ের আশীর্বাদে পেয়ে যান মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের খুচরা মাদক (পেথিডিন) বিক্রয় লাইসেন্স, আর তাতেই তিনি পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে নাহার ফার্মেসি নামক জরাজীর্ণ ও অপরিচ্ছন্ন দোকানে অন্যান্য ওষুধ বিক্রয় বন্ধ থাকলেও বন্ধ নেই (পেথিডিন) নামক মাদক ব্যবসা।

বিজ্ঞাপন

এদিকে নাটোরের নিছা বাজারে অবস্থিত লিড ফার্মেসিতেও চলছে একই কাণ্ড। ফার্মেসি মালিক শফিকুল ইসলাম বেন্টু— বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির জেলা সাধারণ সম্পাদক। কোনোরকম ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কেবলমাত্র মাদকসেবীদের কাছে বিক্রয়ের জন্য এটি সরবরাহ করে থাকেন তিনি। বেন্টু জানান, নাটোর মাদক নিয়ন্ত্রণ অফিসকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই চলছে তার এই কার্যক্রম। নিজস্ব লাইসেন্স না থাকলেও অন্য ফার্মেসির ধারকৃত লাইসেন্স দেখিয়ে আনছেন, পেথিডিন ও বেআইনিভাবে অধিক মূল্যে মাদকসেবীদের কাছে বিক্রয় করে থাকেন।

অভিযোগ রয়েছে, অধিক মুনাফার আশায় এসব দোকানিরা সরকারিভাবে এই ইঞ্জেকশনের মূল্য ৫০ টাকা, কিন্তু নাটোর মাদক নিয়ন্ত্রণ অফিসের টেবিল ও ড্রাগস ইন্টারন্যাশনাল অফিসের টেবিল ঘুরে তার মূল্য এসে দাঁড়ায় ১০০ থেকে ১৮০ টাকা, আর তারা মাদক সেবীদের কাছে বিক্রয় করেন ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা।

মাদক আসক্ত যুবকেরা অন্যান্য মাদকের চেয়ে সহজলভ্য হওয়ায় নিয়মিত নিজের শরীরে পুশ করছেন এই মরণঘাতী ইনজেকশন; এই ওষুধ কেবল মানুষের জীবন বাঁচায় না, মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণের ফলে শরীরের মধ্যে ঘটে নানা জটিলতা ও অঙ্গহানি।

মাদকাসক্ত রাহাদিন জানান, প্রায় তিন বছর ধরে তিনি নিয়মিত এই ইনজেকশন নিয়ে থাকেন, প্রতিদিন তার দুই থেকে তিনটা পেথিডিন ইনজেকশন ব্যবহার করতে হয়। পেথিডিন ব্যবহারের ফলে তার শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ নষ্ট হচ্ছে কিনা বা ক্ষতি হচ্ছে কিনা তা জানা নেই তার। সে নিজেও জানে না তার শরীরে কতগুলো ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়েছে।

আরেক মাদকাসক্ত সাইফুল্লাহ জানান, বন্ধুদের মাধ্যমে জড়িয়ে পড়েন এই নেশায়, আর এ নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য নানান অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। এমনকি নেশার টাকার জোগাড় করতে না পারলে মানুষ মারতেও দ্বিধাবোধ হবে না বলেও জানান তিনি।

মাদকাসক্ত দিদারুল বলেন, সারাদিন রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় হয় তা মাদক সেবন করতেই চলে যায়। দুবেলা পেটে ভাত না থাকলেও সমস্যা হয় না তার। কিন্তু মাদক সেবনের টাকা জোগাড়ের জন্য জড়িয়ে পড়েন চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইসহ নানা অসামাজিক কর্মকাণ্ডে।

নাটোর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক এম সাইফুল ইসলাম জানান, লাইসেন্স ও ডাক্তারের পরিচয়পত্র ছাড়া এর বেচা-কেনা নিষিদ্ধ। যদি কেউ এই আইন অমান্য করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিয়মিত মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার অফিস বা আমি জড়িত নই। যদি অফিসের কোনো কর্মকর্তা অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

নাটোরের সিভিল সার্জন ডক্টর মোহাম্মদ মুক্তাদির আরেফিন জানান, পেথিডিন ও মরফিন সেবনের কারণে মানব দেহের কিডনি, ফুসফুস এমনকি মস্তিষ্ক বিকল হতে পারে, আসলে এটি একটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, সাধারণত রোগীদের অপারেশনের সময় এটি ব্যবহার করা হয়। যদি কোনো ফার্মেসি ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এটি বিক্রয় সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে সিভিল সার্জন অফিস তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর