ঢাকা: দেশের রাজনীতিতে প্রতীক মানে শুধু নির্বাচনি চিহ্ন নয় এটি দলীয় পরিচয়, আদর্শের প্রতিফলন এবং জনমানসে গ্রহণযোগ্যতার প্রতীকও বটে। নতুন প্রজন্মনির্ভর দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন ঠিক এমন এক প্রতীকের লড়াইয়ে নেমেছে, যা দেশব্যাপী নতুন রাজনৈতিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
শাপলার জন্য রাজনৈতিক ঝড়
এনসিপি তাদের প্রতীক হিসেবে চাইছে ‘শাপলা’ যা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাষ্ট্রীয় প্রতীকের অংশ, এবং শান্তি ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, জাতীয় প্রতীক হিসেবে শাপলাকে দলীয় প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না, কারণ এটি নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ২০০৮- এর তালিকায় নেই।
দলের যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির সারাবাংলাকে জানান, “আমরা শাপলা প্রতীক পাওয়ার সমস্ত আইনি অধিকার রাখি। ইসি সচিব নিজেই স্বীকার করেছেন, আইনি কোনো বাধা নেই। এখন যদি বলেন, ‘এটা আমার মর্জি, আমি দিব না’ তাহলে এটা স্বৈরাচারী আচরণ ছাড়া কিছু নয়।”
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘ইসি সচেতনভাবে তাদের প্রতীকপ্রাপ্তি ঠেকাচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।’’
এদিকে দলের দাবি, শাপলার প্রতীক না পেলে তারা বিকল্প কোনো প্রতীক নেবে না। প্রয়োজনে রাজপথে আন্দোলনেও নামবে।
আইন বনাম ইসির ব্যাখ্যা
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে শাপলা যেহেতু জাতীয় প্রতীক, সেটি দলীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে। ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন “বিধিমালায় শাপলা প্রতীক নেই। কমিশন স্ববিবেচনায় এনসিপিকে অন্য প্রতীক দেবে।”
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কোনো রাজনৈতিক দল সেই প্রতীকের জন্য বিধি সংশোধনের আবেদন করে এবং জনমনে সেই প্রতীক ইতিমধ্যেই তাদের সঙ্গে পরিচিতি পায়, তাহলে ইসি কি জনমতের এই প্রতিফলন উপেক্ষা করতে পারে?
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে প্রতীক রাজনীতি
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. রমিত আজাদ মনে করেন, জাতীয় প্রতীককে দলীয় প্রতীকে রূপ দেওয়া বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি করবে।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, “জাতীয় প্রতীক আমাদের সবার, কোনো দলের নয়। সেদিক থেকে শাপলা বাংলাদেশের প্রতীক। তাই রাজনৈতিক দলগুলো এমন প্রতীক বেছে নেওয়া উচিত যা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটায়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় চিহ্নের সঙ্গে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে।”
তবে ড. রমিত আজাদ আরও একটি বিষয় যুক্ত করে বলেন যে, ‘যদি তরুণরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকে, তবে দেশের নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হবে। তাই নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বদের এমন প্লাটফর্ম দিতে হবে যাতে তারা দায়িত্বশীলভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়। এবং তাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক তৈরি না হোক।’
অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিষয়টিকে দেখছেন কিছুটা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে। তিনি সারাবাংলাকে জানান, “শাপলা জাতীয় প্রতীক। এটাকে দলীয় প্রতীক বানানোর চেষ্টা শিশুসুলভ ও রাজনৈতিকভাবে অশোভন।’’
রিজভী বলেন, ‘‘শাপলা এ দেশের জন্মের পর থেকে এটা একটা জাতীয় প্রতীক হিসেবে পরিচিত। ফলে এর আগেও তো অনেক রাজনৈতিক দল এটা নিতে পারতো। কিন্তু শাপলাকে একটা জাতীয় প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেছিল। এখন যেটা করা হচ্ছে, যেভাবে এটাকে নিয়ে মানে দলীয়করণ করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এইটা আমি মনে করি এক ধরনের শিশসুলভ আচরণ।”
তবে রুহুল কবির রিজভী এটাও যুক্ত করেছেন যে, ‘‘গণতন্ত্র মানে ভিন্নমতকেও শ্রদ্ধা করা। তাই এনসিপির দাবি শুনে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়াই উচিত।”
জনতার কাছে এনসিপির পরিচিতি ‘‘শাপলা’’
জুলাই পদযাত্রা এবং তরুণদের হাতে শাপলা প্রতীকের ব্যানার। সব মিলিয়ে এনসিপি ইতোমধ্যে জনগণের মনে এক ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি তৈরি করেছে। রাজনীতিতে এটি একধরনের সাংস্কৃতিক সংযোগও বটে।
জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, শাপলা প্রতীক এখন “গণমানুষের অনুভূতির অংশ”। অতএব এটিকে রাজনৈতিকভাবে অস্বীকার করা মানে জনগণের ইচ্ছাকে অস্বীকার করা। এখন নির্বাচন কমিশন যদি কোনো স্বেচ্ছাচারী আচরণ করেন, তাহলে আমরা তো সেটা মেনে নিব না। আমরা মনে করি উনি আমাদের রাজনৈতিক যে অধিকার এবং এনসিপি শাপলা প্রতীক পাওয়ার যে রাজনৈতিক অধিকার তিনি সেটি ফিরিয়ে দেবেন।
রাজনৈতিক তাৎপর্য
শাপলা-ইস্যু আসলে এখন শুধু একটি প্রতীকের প্রশ্ন নয়; এটি হয়ে উঠেছে ক্ষমতার প্রতীকবাদের নতুন রণক্ষেত্র। ইসি যদি এনসিপিকে প্রতীক না দেয়, তাহলে তরুণদের নেতৃত্বে নতুন এক আন্দোলন শুরু হতে পারে যার প্রতিধ্বনি শুধু রাজপথে নয়, নির্বাচনকালীন রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
একজন সাবেক নির্বাচন পর্যবেক্ষক বললেন “শাপলা ইস্যু এখন এনসিপির ‘রাজনৈতিক পরিচয়ের লড়াই’। এটি তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রতীক হয়ে উঠেছে।”
তবে কি ‘‘শাপলা’’ হতে পারে এনসিপির প্রতীক?
এনসিপির শাপলা এখন রাজনীতির অঙ্গণে এক উত্তাল তরঙ্গ। যদিও বিএনপি নেতারা এনসিপির এই প্রতীক দাবি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। বিশ্লেষকদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে, শাপলা প্রতীক পেতে তেমন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বিধি-ব্যাখ্যা ও এনসিপির প্রতীক দাবির মধ্যে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন এক বিতর্কের সূচনা করেছে । এ বিতর্কের শেষ কোথায় তা সময়ই বলে দেবে।