‘নিজের দেশ আর মানুষের কাছে আসার অনুভূতি অন্যরকম’
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ২০:১৩
জান্নাতুল ফেরদৌসী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
‘মাকে দেখিনি— জানি না বেঁচে আছে কিনা। থাকলেও কেমন আছে, কোথায় আছে? কিন্তু আমি ভাল আছি।’
রোববার বিকেলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘একাত্তরের যুদ্ধশিশুর সাথে আলাপচারিতা’য় এভাবেই কথা শুরু করলেন কানাডা প্রবাসী যুদ্ধশিশু শামা জমিলা মলি হার্ট।
কান্না চাপানো ধরে আসা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘বায়াত্তরে মাদার তেরেসা শিশুভবন ছেড়ে কানাডা যাবার সময় এ দেশে আমার পরিচয় ছিল শত্রু শিশু বা জারজ সন্তান।’
সেদিনের সেই ছোট্ট মলি এখন জানেন পাকস্তানি বাহিনীর বর্বরতায় জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণেই তার জন্ম। এ দেশের মানুষ আর সমাজ তখন তাকে নিজেদের সন্তান বলে মেনে নেয়নি। এমনকি তাকে ফেলে রেখে চলে গেছেন গর্ভধারিণী মাও। কিন্তু মায়ের ওপর এতটুকও ক্ষোভ নেই শামার। বলনেন, ‘মাকে শ্রদ্ধা করি, বুঝতে পারি সে সময় মা কতটা অসহায় আর নিরুপায় ছিলেন।’
শামার সঙ্গে এসেছে তার কিশোরী মেয়ে সাভানা বোনেল। মিলনায়তনে বসা তরুন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে শামা যখন কথা বলছিলেন সাভানা তখন বার বার দেখছিল তার মাকে। গ্রেড সেভেনে পড়া মেয়ের সম্পর্কে শামা হার্ট বললেন, ‘নিজের দেশ আর অনুভূতির সাথে পরিচয়র করিয়ে দিতেই ওকে এনেছি। এটা যে কত বড় আর অন্যরকম অনুভূতি ঠিক প্রকাশ করতে পারব না।’
যুদ্ধশিশু শামা জমিলাকে বাংলাদেশে আসতে সহযোগিতা করা কানাডিয়ান প্রবাসী গবেষক মোস্তফা চৌধুরী জানান, বায়াত্তরের ১৯ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল সোসাল সার্ভিসের(আইএসএস) উদ্যোগে প্রথম ১৫ শিশুকে দত্তক নেন কানাডার ১৪ জন দম্পত্তি। সেই ১৫ জনের মধ্যে শামা একজন। তার দত্তক বাব-মা হলেন জোয়েল হার্ট ও ট্রুডি হার্ট। এই দম্পত্তি বিভিন্ন দেশ থেকে এমন আরও সাতজনকে দত্তক নেন। নিজেদের এক সন্তানসহ মোট নয়জনকে সন্তানের পরিচয়ে বড় করেন বলেও জানালেন মোস্তফা চৌধুরী।
যুদ্ধশিশুর জন্য এমন আয়োজন আর এতে তরুণদের অংশগ্রহণকে দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন জানিয়ে এই গবেষক বলেন, ‘২০ বছর আগে যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে যখন গবেষণা শুরু করি তখন কেউ কথা বলতে চাইত না। কিন্তু আজকের আয়োজন আর অংশগ্রহণ বলছে আমরা খানিকটা বদলেছি। শুধু আমাদের নেতিবাচক মানসিকতার কারণেই এখনো নিজেদের পরিচয় দেন না একাত্তরের নির্যাতিতারা। গবেষণার জন্য দেশের আর্কাইভে এখনো এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
শামা আর তার মেয়ে সাভানার বাংলাদেশে আসা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করেন এই জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি এম সরোয়ার আলী। তিনি বলেন, “পুরান ঢাকার ইসলামপুরের মাদার তেরেসা শিশুভবনে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুরা হলো ‘গড় চিল্ড্রেন’।”
এই মুক্তিযোদ্ধা আরও জানান, আমরা ঋণী এসব যুদ্ধশিশু আর তাদের গর্ভধারিণীদের কাছে। এ ছাড়াও ঋণী কানাডার সেইসব দম্পত্তির কাছে যারা সে সময় শামাদের নিজের দেশে নিয়ে নিরাপদ বাড়ি আর স্নেহ-ভালবাসায় প্রতিষ্ঠিত সুন্দর জীবন দিয়েছে।
অনুষ্ঠান শুরুর আগে পুরো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখেন শামা হার্ট আর তার মেয়ে সাভানা। হাসি-খুশি আর বিনয়ী শামা এ সময় বলেন, ‘আমার মেয়ে সাভানা জমানো টাকা আর অনেক উপহার এনেছে আমার দেশের অসহায় মানুষদের জন্য। আমরা আবার আসতে চাই। খুব সুন্দর এই দেশ। তার চেয়েও বেশি ভাল এখানকার মানুষগুলো। আমাকে ভীষণ আপন করে নিয়েছে সবাই। মনেই হচ্ছে না এই প্রথম এলাম।
সারাবাংলা/জেডএফ/আইজেকে