Wednesday 29 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাই গণহত্যা
হৃদয় খুনের মামলায় আসামিকে জামিন দেওয়া বিচারক ‘পুরস্কৃত’!

উজ্জল জিসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৯ অক্টোবর ২০২৫ ১০:১৭ | আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:১৬

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হৃদয়। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: জুলাই আন্দোলনের সময় গাজীপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে হৃদয় নামে এক শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যার মামলায় জামিন পায় পুলিশ কনস্টেবল আকরাম। পরে অবশ্য ফের গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন। কিন্তু প্রধান আসামিকে জামিন দেওয়া সেই বিচারককে এবার ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর এই নিয়োগকে ভিকটিমের পরিবার ও জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত স্টেক হোল্ডাররা ‘পুরস্কার’ হিসেবে দেখছেন।

জুলাই স্টেক হোল্ডারদের অভিযোগ, হত্যাকারী পুলিশ কনস্টেবলকে জামিন দেওয়ায় গাজীপুরের রাজপথে নেমে আসে সাধারণ মানুষ। তারা বিচারকের অপসারণ চেয়ে আন্দোলন শুরু করে। এর পর বিচারক শামীমা আফরোজকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছিল। তারও প্রায় একবছর পর তাকে এবার ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

বিজ্ঞাপন

গত ২৩ অক্টোবর আইন ও বিচার বিভাগ থেকে উপসচিব (প্রশাসন-১) মনজুর কাদেরের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে ৩১ জনকে বিভিন্ন আদালতে বিচারক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। এই প্রজ্ঞাপনের ১৮ নম্বরে রয়েছে বেগম শামীমা আফরোজের নাম। ২৯ অক্টোবর ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক হিসেবে তার যোগদানের কথা রয়েছে। এর আগে তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। তবে তার এই নিয়োগের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। জুলাইয়ের স্টেক হোল্ডারদের দাবি, অবিলম্বে বেগম শামীমা আফরোজের বদলির আদেশ স্থগিত করে তাকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।

শিক্ষার্থীকে হৃদয়কে গুলি করে হত্যার মামলায় পুলিশ কনস্টেবল আকরামকে জামিন দেওয়া বিচারকের অপসারণ ও বিচার দাবিতে মানবন্ধন। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীকে হৃদয়কে গুলি করে হত্যার মামলায় পুলিশ কনস্টেবল আকরামকে জামিন দেওয়া বিচারকের অপসারণ ও বিচার দাবিতে মানবন্ধন। ছবি: সংগৃহীত

কলকাঠি নাড়ছে কে?

বেগম শামীমা আফরোজের স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য ছিলেন তিনি। এছাড়া, তিনি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্যও। যদিও নিয়ম অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতা পিএসসির সদস্য থাকতে পারেন না। কিন্তু তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে একসঙ্গে রাজনৈতিক ও সরকারি পদে বহাল ছিলেন। গতবছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার পিএসসির পদ চলে যায়।

মূলত স্বামীর জোরেই শামীমা আফরোজ সবসময় সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন। হত্যাকারী পুলিশ কনস্টেবলকে জামিন দেওয়ার বিষয়টিও তার স্বামীর কারণেই হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তির পর সেখান থেকে ফের বিশেষ জজ আদালতে বিচারক হিসেবে বদলির বিষয়টিও তার স্বামীর কারণেই হয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের। তাদের দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক সংগঠন নীল দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন-ই আইন মন্ত্রণালয় ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ম্যানেজ করেই এই নিয়োগ করিয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, শামীমা আফরোজের স্বামী আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার কারণেই তিনি সবসময় ঢাকা ও আশেপাশের জেলাগুলোতে চাকরি করেছেন। নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও ঢাকায় চাকরির রেকর্ড রয়েছে তার। এছাড়া, সুবিধাও নিয়েছেন বড় বড়। ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি-বাড়ি কোনোকিছুরই অভাব নেই তাদের। যদিও এসব তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

জুলাই অ্যালায়েন্স যা বলছে

জুলাই অ্যালায়েন্সের দাবি, আওয়ামী লীগ করার কারণে তৎকালীন সরকার অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনকে পিএসসির সদস্য পদ দিয়ে পুরস্কৃত করে। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির সদস্যও করে। সেই ব্যক্তির স্ত্রী বেগম শামীমা আফরোজ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর একটি আলোচিত মামলায় আসামি পুলিশ কনস্টেবল আকরাম হোসেনকে শাস্তির পরিবর্তে জামিন দেন। এরকম একটি আলোচিত মামলায় আসামিকে জামিন দেওয়ায় সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। এর পর তাকে ‘শাস্তি’ না দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। যদিও একবছর যেতে না যেতেই শামীমা আফরোজকে ‘পুরস্কার’ হিসেবে ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক হিসেবে বদলি করল সরকার। এতে ভিকটিম পরিবার চরম ক্ষুব্ধ। সেইসঙ্গে জুলাই আন্দোলনের জড়িতরাও ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন।

শিক্ষার্থীকে হৃদয়কে গুলি করে হত্যার মামলায় পুলিশ কনস্টেবল আকরামকে জামিন দেওয়া বিচারকের অপসারণ ও বিচার দাবিতে মানবন্ধন। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীকে হৃদয়কে গুলি করে হত্যার মামলায় পুলিশ কনস্টেবল আকরামকে জামিন দেওয়া বিচারকের অপসারণ ও বিচার দাবিতে মানবন্ধন। ছবি: সংগৃহীত

মর্মান্তিক সেই ৫০ সেকেন্ড

৫ আগস্টের মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। ৫০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও, এই দৃশ্য যে কারও অন্তরে কাঁপন ধরাবে। যেখানে কলেজ পড়ুয়া একটি ছেলেকে ধরে আছে কয়েকজন পুলিশ সদস্য। চড়-থাপ্পড়, কিল- ঘুষি মারছে। কেউ কেউ আবার কলার ধরে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। একটু দূর থেকেই দৌড়ে এলো এক পুলিশ সদস্য। কাছে এসেই কলেজশিক্ষার্থী হৃদয়ের পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দিল। গুলির বিকট শব্দ। মাত্র তিন সেকেন্ডেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল হৃদয়। ছটফট করে হাত-পা নাড়ার চেষ্টা। এমনকি দাঁড়াতে গিয়ে ব্যর্থ। একটু পরেই নিথর মাটিতে পড়ে থাকা হৃদয়ের দেহ। স্রোতের বেগে রক্ত বের হতে থাকে। অল্প সময়েই রাস্তা লাল হয়ে যায়। পরনের কাপড় ভিজে যায়। গুলি করেই পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে সরে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার তারা হৃদয়ের কাছে ফিরে আসে। এসে নিথর দেহ পা দিয়ে ঠেলে দেখতে থাকে মারা গেছে কি না। পরে চার পুলিশ সদস্য মিলে হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ মরদেহ হাত-পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে দূরে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো হৃদয়ের মৃতদেহ? কেউ জানে না এখনো।

সেদিন ওই এলাকায় ছিল, শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ এর ২০ জন কনস্টেবল, কোনাবাড়ী থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের সদস্যরা। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তখন পালাতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি তারা থানা ছেড়েও পালিয়ে যায়।

কে এই হৃদয়

পুলিশের গুলিতে নিহত হৃদয় টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি টাঙ্গাইল হেমনগর ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। অভাবের সংসারের হাল ধরতেই তিনি গাজীপুরে এসে অটোরিকশা চালাতেন। গত ৬ আগস্ট থেকেই গাজীপুরের বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে খুঁজেও হৃদয়ের মরদেহের সন্ধান পায়নি পরিবার। ৭ আগস্ট থানায় গিয়ে কোনো পুলিশ সদস্যকেও দেখতে পায়নি পরিবারের লোকজন। মূলত ৫ আগস্ট থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশশূন্য ছিল কোনাবাড়ী থানা। ফলে হৃদয়ের মরদেহের সন্ধানও মেলেনি।

এর মধ্যে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে পুলিশে ব্যাপক রদবদল হয়। কোনাবাড়ী থানায় ৫ আগস্টের আগে কর্মরত পুলিশের অধিকাংশ সদস্যকেই অন্যত্র বদলি করা হয়। ফলে হৃদয়ের মরদেহ কোথায় রাখা হয়- সেই প্রশ্নের উত্তর আজও পায়নি পরিবার। এখনো ছেলের মরদেহের খোঁজে পুলিশের কাছে ধরনা দিচ্ছে তারা। কিন্তু, ছেলের খোঁজ মিলছে না। বরং, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে প্রথমে জামিন দেওয়া (পরে বাতিল) বিচারককে বিশেষ জজ আদালতে বদলি করা হয়েছে।