Wednesday 29 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘তত্ত্বাবধায়ক’ বা ‘অন্তর্বর্তী’
নিরপেক্ষতার পরীক্ষায় বাংলাদেশের রাজনীতি

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৯ অক্টোবর ২০২৫ ২২:৫৮ | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ০০:৪৩

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক ও বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: বাংলাদেশ ফের এক নির্বাচনের মোড়ে দাঁড়িয়ে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আসছে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তাই এখন রাজনীতির বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে পুরনো একটি শব্দ ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। এক দশক আগে সংবিধান থেকে বিলুপ্ত এই ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের দাবি এখন বিএনপির কণ্ঠে নতুনভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। তবে এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকেই বিএনপি এখন তত্ত্বাবধায়ক কাঠামোয় রূপ দেওয়ার কথা বলছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ভাষায়, ‘নির্বাচনকে অর্থবহ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের আদলে যেতে হবে। অর্থাৎ, আমরা একটি প্রশাসনিক রূপান্তর চাচ্ছি। যেখানে দলীয় আনুগত্য নয়, নাগরিক আস্থা হবে মূল চালিকাশক্তি।’

বিজ্ঞাপন

তত্ত্বাবধায়ক বিতর্কের পুনর্জাগরণ

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক সংকট থেকে জন্ম নেয়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এটি ছিল নির্বাচনের নিরপেক্ষতার প্রতীক। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিলের পর থেকেই রাজনীতিতে আস্থার সংকট শুরু হয়। ২০২৫ সালে এসে সেই সংকট ফের মাথা চাড়া দিয়েছে। তবে এবার তা অন্য রূপে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে বিএনপি বলছে, যদি তারা সত্যিই নিরপেক্ষ হতে চায়, তাহলে নিজেদের কাঠামোতে তত্ত্বাবধায়ক ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদের দাবি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও জেলা প্রশাসনকে পুনর্গঠন করতে হবে, যেন নির্বাচনকালীন কোনো দলীয় প্রভাব না থাকে।

সরকার বনাম আস্থার রাজনীতি

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতান মাহমুদ রানার সঙ্গে। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “যে প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্রে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে, ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের প্রতিনিধিত্ব এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। বিএনপির আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ যদি দলীয় রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তবে নির্বাচনের মাঠে সব দলের জন্য সমান সুযোগ বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই তারা এমন একটি ব্যবস্থা চাইছে, যা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে শুধু নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব পালন করবে, যে ভূমিকাটি ঐতিহ্যগতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছিল।’’

তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির এই দাবিটি নিছক একটি রাজনৈতিক চাণক্য নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক গভীর সংকটের প্রতিফলন। অন্তর্বর্তী সরকার বনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিতর্কটি আসলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষারই ভিন্ন রূপ।’

অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একদিকে সংস্কার ও পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্বও তাদের কাঁধে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রশাসনের পুরনো রক্তে নিরপেক্ষতা কতটা সম্ভব?

শিক্ষাবিদ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রমিত আজাদ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত ও নিয়োগগুলোকে হতে হবে সম্পূর্ণ দলনিরপেক্ষ। বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সেতু তখনই তৈরি হয়, যখন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দলমুক্তভাবে কাজ করে।’

অবিশ্বাসের রাজনীতি ও ভবিষ্যতের পথ

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির এ বিষয়ে বলেছেন, ‘যদি সরকার তত্ত্বাবধায়কধারার মতো কোনো কাঠামো না নেয়, তাহলে নির্বাচনের সময় সংঘাত হবেই। আর সংঘাত হলে সরকারের উন্নয়নমূলক অর্জনও ম্লান হয়ে যাবে।’

অধ্যাপক সুলতান মাহমুদ রানার ভাষায়, তিনটি দিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা জেলা প্রশাসন কোনো রাজনৈতিক নির্দেশে কাজ না করে। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা রক্ষা, সংস্থাটিকে হতে হবে মাঠের ‘রেফারি’, যে পক্ষপাতদুষ্ট খেলোয়াড়কে নির্দ্বিধায় মাঠ থেকে বের করে দিতে পারে। রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, যারা এখনো নির্বাচনি প্রক্রিয়ার বাইরে, সেই ২৫-২৮টি দলকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক যুগসন্ধিক্ষণে। একদিকে উন্নয়ন, অন্যদিকে আস্থার সংকট। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ। বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত বা অন্য কোনো দল নয়, বরং জনগণই এখন নিরপেক্ষ সরকারের সবচেয়ে বড় দাবিদার। তত্ত্বাবধায়ক হোক বা অন্তর্বর্তী হোক; নাম নয়, জনগণের বিশ্বাসই হবে আগামী নির্বাচনের প্রকৃত সংবিধান- এমনটাই মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর