রংপুর: হিমালয়ের কোল ঘেঁষা উত্তরের জনপদে কুয়াশা নামছে ফিনফিনে ঘোমটা হয়ে। সূর্যের প্রখরতা ম্লান, ধানের ডগায় শিশির ঝিকমিক করে মুক্তোর মতো। হেমন্ত এসেছে নীরবে, তার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে হিমেল হাওয়ায়, শুকনো পাতার দোলায়। রংপুরের মাঠে-প্রান্তরে শীতের আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে—কখনো কুয়াশার চাদরে, কখনো শিউলির ঝরা পাপড়িতে।
সকালে ঘাসের ডগায় শিশিরের ফোঁটা, মাকড়সার জালে হিরের মালা। কাশফুল দোলে বাতাসে, দূরে কাকের কা-কা। সন্ধ্যার পর থেকে রাতভর হালকা কুয়াশা ঝরছে, যা সকাল ৭-৮টা পর্যন্ত থাকছে। রংপুর শহরতলীর কলেজ রোডে ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে রাতু রুমানা চৌধুরী স্নেহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘন কুয়াশায় মনে হয় শীত নেমে এসেছে।’ সন্ধ্যা নামতেই কুয়াশা ঝরে, রাত ১২টার পর ঠান্ডা বাড়ে। গভীর রাত থেকে ঘন কুয়াশা, হেডলাইট জ্বালিয়ে চলে যানবাহন। শ্রমজীবীরা গায়ে জড়াচ্ছেন গরম কাপড়, দোকানে উঠছে পিঠার ধোঁয়া।
কবি সুফিয়া কামালের ভাষায়, ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/ কোন্ পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে?’ জীবনানন্দ দাশের ‘পিপাসার গান’-এ হেমন্তের অলস মেয়ে রৌদ্রের রস চুমে নেয়। হেমন্ত শরৎ ও শীতের সেতুবন্ধ, ধান্যলক্ষ্মীর আশীর্বাদ নিয়ে আসে। আকাশ নির্মল নীল, দুপুরের রোদ মিষ্টি হলুদ। বিকেলে গোধূলি মায়া, সন্ধ্যা দ্রুত নামে। শীতের পায়ের ধ্বনি কাছে, উত্তরের জনপদে শুরু হয়েছে উৎসব আর কষ্টের দোলা।

হেমন্তকালে কুয়াশা ও শিশির ভেজা সকালে শীতের আগমনী বার্তা শোনা যায়। ছবি: সারাবাংলা
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, তাপমাত্রা এখন ১৮-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে; সপ্তাহ শেষে নামতে পারে ১৫ ডিগ্রিতে। রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে আরও কমবে, শীতের আমেজ গাঢ় হবে।’
নগরীর বাসিন্দা রাতু রুমানা চৌধুরী স্নেহা জানালেন, ‘সামনে নবান্ন উৎসব শুরু হবে। আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য এটি। এখন হালকা শীত আছে। রাত ৮টার পর থেকে একটু কুয়াশা হয়। তারপর একটু ঠান্ডা পড়ে। ভোরের দিকে বেশ ঠান্ডা থাকে এবং সন্ধ্যা নামার পর থেকেই কুয়াশা শুরু হয়।’
হেমন্তের ভোরে ঘাসের ডগায় শিশিরকণা মুক্তার মতো ঝিকমিক করে, শিউলি ফুলের পাপড়িতে জমে থাকে হিরের দ্যুতি। মাঠজুড়ে সোনালি ধানের ঢেউ, বাতাসে নতুন চালের মিষ্টি ঘ্রাণ। গ্রামাঞ্চলে হেমন্ত মানেই নবান্নের উৎসব। কৃষকরা কাস্তে হাতে ধান কাটায় মগ্ন, উঠানে মাড়াইয়ের জয়গান। উঠানে নতুন চালের গুঁড়া, ঘরে পিঠা-পায়েসের ম-ম ঘ্রাণ। গ্রামের পুকুরঘাটে শিশুরা শাপলা ছিঁড়ে খেলা করে, মেয়েরা কলসি হাতে হাসে। দূরে কাশফুলের দোলা, কাকের কা কা শব্দে মিশে যায় পাতাঝরার ঘ্রাণ। কৃষকের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। কিন্তু গরিবের কাছে শীত নেমে আসে কষ্ট হয়ে।

কুয়াশার কারণে মহাসড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করে যানবাহনগুলো। ছবি: সারাবাংলা
কার্তিকের প্রথমে কুয়াশার নরম ঘোমটা টেনে গ্রামে সকাল যেমন শুরু হয় শহরের তুলনায় একটু আগেভাগে, তেমনি রাত আসে সন্ধ্যে নামার পরই। তাইতো পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা বাজারের দোকানদার মন্টু মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকাল সকাল বন্ধ হয় দোকান, ব্যবসা মন্দা।’এদিকে হালকা শীতের অনুভূতিতেই প্রবীণরা ভোগেন সর্দি-জ্বরে। কামাল হোসেন বলেন, ‘কুয়াশা মানেই শীতের নমুনা, চলাচলে বিঘ্ন হলেও স্নিগ্ধ আবহাওয়া ভালো লাগে।’
চতরা কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হারুন অর রশীদ চৌধুরী সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘হেমন্ত, কুয়াশা এবং শীত মিলে বাঙালির এক বিশেষ ঐতিহ্য তৈরি করে, যেখানে হেমন্তকালে কুয়াশা ও শিশির ভেজা সকালে শীতের আগমনী বার্তা শোনা যায়, যা গ্রামীণ সংস্কৃতি ও প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময় নতুন ফসল ঘরে তোলা হয় এবং শীতের প্রস্তুতি শুরু হয়, যা বাংলাদেশের ঋতুচক্রের একটি অংশ এবং বাঙালির জীবনে এক ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে, যা নতুন প্রজন্মকে তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।’
এদিকে ভোর সকালে ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকছে পথঘাট। কুয়াশার কারণে মহাসড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করে যানবাহনগুলো। কুয়াশার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে। আর ঢাকা-রংপুর রুটে সকালে যান চলাচলে শুরু হয়েছে ধীরগতি।