Saturday 01 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লোকগানের প্রাণপুরুষ আয়াজ বাঙ্গালী
সুর আছে-স্বীকৃতি নেই, গানেই বাঁচেন জীবন্ত কিংবদন্তি

জুলফিকার তাজুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১ নভেম্বর ২০২৫ ১৮:৫৮ | আপডেট: ১ নভেম্বর ২০২৫ ২২:০১

সিলেটি আঞ্চলিক গানের জীবন্ত কিংবদন্তি ফকির আয়াজ বাঙ্গালী। ছবি: সারাবাংলা

সিলেট: সিলেটের লোকগানের এমন এক প্রাণপুরুষ, যার গান আজও মুখে মুখে ফেরে, অথচ তিনি নিজে আছেন অবহেলার ছায়ায়। তিনি ফকির আয়াজ বাঙ্গালী—সিলেটি আঞ্চলিক গানের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। সুরে, কথায় ও দরদে মানুষকে জয় করলেও জীবনযুদ্ধে এখন তিনি অভাবের তাড়নায় ক্লান্ত। ১১ সদস্যের সংসার সামলাতে প্রতিদিন চলছে টানাপোড়েন, তবুও গানে বাঁচেন, গানের মধ্যেই খুঁজে পান শান্তি।

যার লেখা গান গেয়ে অনেকে তারকা খ্যাতি পেয়েছেন। দেশ-বিদেশে মঞ্চ থেকে টেলিভিশন ও ইউটিউবের পর্দায় রাজত্ব করছেন। প্রবাসী সিলেটিদের কাছে যার কদর পাহাড় তুল্য। অথচ এই লোকশিল্পী আজও বেতার কিংবা টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকারের খাতায় নাম লেখাতে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

দেশি-বিদেশি ভক্তদের কাছে সহযোগিতা চেয়ে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি খুলে বলেছেন মনের কথা। সেই মানবিক আলাপনেই উঠে এসেছে তাঁর জীবনের আনন্দ-বেদনার গল্প।

গণমাধ্যমে কথা বলছেন ফকির আয়াজ বাঙ্গালী। ছবি: সারাবাংলা

সিলেটের লোকগানে যাদের গৌরবময় বিচরণ, সিলেটি আঞ্চলিক ভাষাকে যারা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত করেছেন—আয়াজ বাঙ্গালী তাদের একজন। তাঁর জনমুখী গানে ফুটে ওঠে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের কঠিন বাস্তবতা, সমাজের টানাপোড়েন আর মমতার রঙ। উচ্চশিক্ষা না থাকলেও, তার গানের ভাষা এমন সাবলীল ও মায়াময় যে শ্রোতারা সহজেই হারিয়ে যান কথা ও সুরের মায়ায়।

১৯৫৯ সালের ১০ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার কেছরীগুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আয়াজ বাঙ্গালী। তার পিতার নাম আশিদ আলী ও মাতা নেছা বেগম।

ছোটবেলায় কেটেছে চরম অভাবের মধ্য দিয়ে—অন্যের বাড়িতে গরু চরানো, ঈদের দিনও কাজ থেকে ছুটি না পাওয়া, এসবই ছিল তার বেড়ে ওঠার অংশ। কিন্তু সংগীতের প্রতি অনুরাগ থামেনি কখনোই। ১৯৮৬ সালে শুরু করেন গান লেখা ও গাওয়া, আর ১৯৯৬ সালে পান তাঁর সংগীতগুরু মির মোহাম্মদ রানু সরকারকে।

নিজ বসতঘরের সামনে আয়াজ বাঙ্গালী

নিজ বসতঘরের সামনে আয়াজ বাঙ্গালী

নিজেই লেখেন, সুর করেন, আবার নিজেই কণ্ঠ দেন। তার কণ্ঠে সিলেটি উচ্চারণের দরদ এমনই অনবদ্য যে শ্রোতারা বারবার ফিরে আসেন। ‘আমার গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে, এটাই আমার বড় প্রাপ্তি,’ বলেন আয়াজ বাঙ্গালী।

আঞ্চলিক গানের পাশাপাশি প্রেম, বিরহ, সামাজিক অসঙ্গতি—সবই উঠে আসে তার গানে। সহজ ভাষায় বলা কথাগুলোই যেন হয়ে ওঠে গভীর দর্শনের প্রতীক। তার লেখা অনেক গান ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, আজও তিনি বেতার কিংবা টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার বা শিল্পী হতে পারেনি।

‘আমার গান মানুষ জানে, কিন্তু আমি থেকে যাই অচেনা। বেতারে আমার নাম নেই, টেলিভিশনেরও দরজা খুলে না। তারপরও আমি গাই, কারণ গানই আমার জীবন,’ কণ্ঠে বিষাদের ছোঁয়া নিয়ে বলেন এই শিল্পী।

আয়াজ বাঙ্গালীর গানে সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দ, জীবনযাত্রা, প্রথা আর মানুষের আবেগের এমন সংমিশ্রণ দেখা যায় যা অন্য কোথাও বিরল। নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে থেকে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের গানের জগৎ—যেখানে জায়গা পায় শ্রমজীবী মানুষ, কৃষকের ঘাম, প্রেমিকের বেদনা আর মায়ের মমতা।

তার গানের একটি বিশেষ দিক হলো—মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি। ‘আমার গানে আমি মানুষের কথা বলি। যে মানুষ দিনরাত খেটে খায়, যে কষ্টে থেকেও হাসে—তাদের গল্পই আমার গানে,’ বলেন আয়াজ বাঙ্গালী।

আয়াজ বাঙ্গালীর অডিও অ্যাবামের কভার। ছবি: সংগৃহীত

অভাবই যেন এই শিল্পীর চিরসঙ্গী। ১১ সদস্যের পরিবার নিয়ে প্রতিদিন চলছে টানাপোড়েন। তবু তার মুখে অভিযোগ নেই, আছে কৃতজ্ঞতা। তিনি বলেন, গান আর গলাটা হলো বেঁচে থাকার অবলম্বন। গানের আসর বসলে গলায় সুর ওঠে, গলা চললে পেট চলে।

‘ভক্তরা ভালোবাসে, কেউ কেউ খোঁজও নেয়। কিন্তু সংসারের খরচ তো ভালোবাসায় চলে না। তবুও গাই—কারণ গানের ভেতরেই পাই শান্তি,’ বলেন তিনি।

লোকগান এখন বিপন্ন প্রায়। যন্ত্রসঙ্গীতের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সুরের সৌন্দর্য। এই প্রসঙ্গে আয়াজ বাঙ্গালী বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক প্রতিভাবান লোকশিল্পী পড়ে আছে আলোচনার বাইরে। তাদের সম্মান দিলে, বাংলা লোকগান নতুন প্রাণ পাবে।’

গান তার প্রাণ, সুর তার ধ্যান। দারিদ্র্য কিংবা উপেক্ষা কিছুই থামাতে পারেনি আয়াজ বাঙ্গালীকে। আজও তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের গান—যে গান মাটির ঘ্রাণে ভরা, যে গান মিশে আছে মানুষের ভালোবাসায়।

আয়াজ বাঙ্গালীর গানগুলো হারিয়ে যাওয়া কিংবা বিকৃত হওয়ার আশঙ্কায় কবি ও লোক গবেষক মৃণাল কান্তি দাস একটি গ্রন্থ সম্পাদনার তাগিদ অনুভব করেন। সেই প্রচেষ্টা সফল করতে এগিয়ে আসেন গীতিকার, প্রকাশক এবং মাছরাঙা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী আবুল কাসেম। ‘চৌদ্দ নম্বর বেয়াক্কল’ নামে একটি গ্রন্থ একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। যে গ্রন্থে স্থান পেয়েছে চার শতাধিক গান। বাণিজ্যিক লাভের আশায় নয় বরং এই উদ্যোগ যেন অন্যদের প্রেরণা জোগায় যাতে; আয়াজ বাঙ্গালীর মত শিল্পীরা ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে না যান।

আয়াজ বাঙ্গালী রচিত উল্লেখযোগ্য গান

বাউল ফকির আয়াজ বাঙ্গালীর উল্লেখযোগ্য গান হলো– চৌদ্দ নম্বর বেয়াক্কল, তাওয়ার মাঝে দে লাড়া, দেখিছ কিতা করে গো তাই, শাকেরার মা দেউ না তুরা ঝুল, ফাইভের ভিতরে টেম্পু যায়নি, কন্যা সুন্দর ভাদেশ্বর, সরল মনে কাপড় তুলো দেখি তোমার মুখকান, ওগো মায়া লাগাউরি, কানারে পথ দেখানি ভালা নায় এমন অসংখ্য গান তিনি লিখেছেন ও কন্ঠ দিয়েছেন।

লোকগানের জগতে আয়াজ বাঙ্গালী কেবল একজন শিল্পী নন—তিনি এক অনুপ্রেরণা। অভাব, অবহেলা আর উপেক্ষা পেরিয়ে তিনি যে মাটির সুরে আজও বেঁচে আছেন, সেটাই তার সবচেয়ে বড় জয়। তার গানে যেমন আছে মাটি, তেমনি আছে মানুষের নিঃশ্বাস। হয়তো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখনো মেলেনি, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে তিনি ইতিমধ্যেই অমর হয়ে গেছেন।

বাংলা লোকগান বাঁচবে, যতদিন আয়াজ বাঙ্গালীর মতো মানুষ থাকবে। তার সুরের আলোয় হয়তো একদিন আলোকিত হবে সেই অন্ধকার ঘর, যেখানে শিল্পীরা আজও অপেক্ষায়—একটু প্রাপ্য সম্মানের জন্য। আয়াজ বাঙ্গালীর গান বেঁচে থাকুক যুগে যুগে, তার জীবন হোক সুরের মতোই শান্ত ও দীপ্ত।

ফকির আয়াজ বাঙ্গালীর কথা ও সুরে গাওয়া ‘আসল আর নকল’ গানটি ৪/৫ বছর আগে কন্ঠ শিল্পী আশিক তার নিজ কন্ঠে নতুন করে গানটি গেয়ে ইউটিউবে রিলিজ করলে মুহুর্তেই নেট দুনিয়ায় ঝর তুলে। আলোচিত এই গান মাত্র কয়েকমাসে একটি ইউটিউব চ্যানেলে ভিউ হয় ২০ কোটি। সেই থেকে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে বাউল আয়াজ বাঙ্গালীর নাম।

সারাবাংলা/জিজি/এসএস