রংপুর: রংপুরের তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর ডাঙ্গাপাড়ায়, একটা ছোট্ট মাটির বাড়িতে আজ উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়েছে। গেটে ঝলমলে ফুলের মালা, প্যান্ডেলে রঙিন কাপড়ের ছাউনি। দু’দিন ধরে ডেকোরেটররা হাত চালাচ্ছেন, যেন কোনো দুঃখের ছায়া না লাগে। বরযাত্রীদের জন্য কেনা হয়েছে তিনটি খাসি। কিন্তু এই আয়োজনের মাঝে একটা ফাঁকা জায়গা; যেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল রুপলাল রবিদাসের। আজ রোববার (২ নভেম্বর) তার বড় মেয়ে নুপুরের বিয়ের দিন। কিন্তু বাবা নেই।
নুপুর বসে আছে বিয়ের সাজে। লাল শাড়ি, সোনার গয়না চকচক করছে। চোখে কাজল, ঠোঁটে হাসি। কিন্তু মনের ভেতরে একটা গভীর ক্ষত; যেটা কোনো সাজে ঢাকা পড়ে না।
“বাবা থাকলে মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, ‘যা মা, সুখী হ।’ কিন্তু এখন কে বলবে?” কাঁদো কাঁদো সুরে কথাগুলো বলছিলেন নুপুর। তার বাবা রুপলাল, যিনি তারাগঞ্জ বাজারে জুতো সেলাই করে সংসার চালাতেন, তিনি আর নেই। চুরির অপবাদে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন; ঠিক সেই দিনটাতে, যেদিন মেয়ের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে যাচ্ছিলেন।
সবকিছু শুরু হয়েছিল ৯ আগস্ট রাতে। রুপলাল তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপকে নিয়ে ভ্যানে বাড়ি ফিরছিলেন। প্রদীপ মিঠাপুকুরের বালুয়াভাটা গ্রামের ছেলে, পরিবারের অভিভাবকের মতো। পরদিন ১০ আগস্ট, নুপুরের বিয়ের তারিখ ঠিক করার অনুষ্ঠান। প্রদীপকে ডেকেছিলেন রুপলাল। কিন্তু বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে পথ আটকে দাঁড়ায় কয়েকজন। ‘চোর!’– চিৎকার উঠতেই শুরু হয় মারধর। প্রদীপের ব্যাগে পাওয়া যায় একটা স্পিড ক্যানের বোতল, দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় আর কিছু ঔষধ। উত্তেজনায় মব গড়ে ওঠে। লাঠি, রড, লোহার সোঁটা বেধড়ক পিটুনি। রুপলাল ঘটনাস্থলেই মারা যান। প্রদীপ পরদিন হাসপাতালে। দু’জনের মৃত্যুতে থমকে যায় নুপুরের বিয়ের স্বপ্ন।
রুপলালের সংসার ছিল অনটনের। দুই মেয়ে, এক ছেলে। নুপুর তারাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রি পড়ছে, ছোট রুপা ষষ্ঠ শ্রেণিতে, ছেলে জয় নবমে। স্ত্রী ভারতী রানী জুতো কারখানায় কাজ করতেন, কিন্তু অসুস্থতায় ছেড়ে দিয়েছেন। রুপলালের কাঁধে সব বোঝা। প্রতিদিন বাজারে বসে জুতো সেলাই, রাতে বাড়ি ফিরে হাসি মুখে বলতেন, ‘দেখো, তোমাদের জন্য সব করব।’ কিন্তু এখন সেই কাঁধ নেই।
বাবার মৃত্যুর শোক কিছুটা কাটতেই ফের শুরু হয় বিয়ের আলোচনা। রংপুর সদরের চন্দনপাটের কমল রবিদাসের সঙ্গে আজ নুপুরের বিয়ে। হিন্দু রীতিতে সোনার গয়না, ঘরসজ্জা, ৪০০ জনের আপ্যায়ন। ভারতী রানী ধারদেনা করে জোগাড় করছেন সব। কিন্তু হৃদয়ে কান্না।
ভারতী রানী বলেন, ‘আমার ভাস্তি জামাই প্রদীপ ছিলেন অভিভাবক। তাকে ডেকেছিলাম বায়না দেওয়ার জন্য। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগের দিনই…’ ছোট ছেলে জয়, মাত্র নবম শ্রেণির ছেলে, এখন সংসারের কর্তা। ‘বাবা নেই, আমাকেই সব করতে হচ্ছে। হাট থেকে খাসি কিনেছি, গয়না কিনেছি। অনেক টাকা লাগছে। মামা সাহায্য করছেন, কিন্তু প্রশাসন? কেউ খোঁজ নেয়নি।’
এ ঘটনার পর সারাদেশে চাঞ্চল্য। নুপুর বলেন, ‘নেতারা, প্রশাসন– সবাই আশ্বাস দিয়েছিলেন। উপজেলা থেকে এক লাখ, সমাজসেবা থেকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। আমার পড়াশোনার ভাতা, মায়ের বিধবাভাতা, জয়ের জন্য দোকানের জায়গা। কিন্তু, আশ্বাসের মাস পেরোতেই ভুলে গেছে সবাই। মামলা হয়েছে, ৫০০-৭০০ জন অজ্ঞাত আসামি। গ্রেফতার মাত্র ছয়জন। হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরছে, সবাই দেখছে, কেউ বলছে না।’
সন্ধ্যায় বিয়ের পিঁড়িতে বসে নুপুর। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে বাবার হাতের ছোঁয়া। জয়ের কাঁধে স্কুল ব্যাগের বদলে সংসারের বোঝা। ভারতী বলছেন, ‘ছেলেমেয়েরা কীভাবে লেখাপড়া করবে? আমি একা কী করব? এই বিয়ে শুধু উৎসব নয়, একটা যুদ্ধ। দুঃখের সঙ্গে লড়াইয়ের।’
তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানা বলেন, ‘রূপলালের মেয়ের বিয়ের জন্য এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ছেলে ও ছোট মেয়ের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে তারাগঞ্জ বাজারে রূপলালের ছেলের জন্য একটি দোকান দেওয়া হবে। আমরা সবসময় তাদের পাশে আছি।’
স্থানীয়রা নুপুরের বিয়েতে ভীষণ খুশি। তারা বলছেন, রুপলালের অভাবে যে ফাঁকা জায়গা, সেটা কোনোদিন ভরবে না। কিন্তু নুপুরের হাসিতে, জয়ের চেষ্টায়, ভারতীর ধৈর্যের জীবন চলবে।