ঢাকা: বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে জাতীয় স্ট্রাটেজি বা কৌশল নাই। সেইসাথে এই কৌশলের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার বা ইক্রেমেন্টাল পরিকল্পনাও নাই। বাংলাদেশের রেগুলেটরি ম্যাপিং প্রয়োজন। রেগুলেটরির বিভিন্ন জায়গায় বাধা আছে। এগুলোকে এক দৃষ্টিতে শনাক্তকরণ সম্ভব না। রেগুলেটরি ম্যাপিং ব্যাংকের ক্ষেত্রে ক্যাপিটালাইজেশন, নন পারফর্মিং লোন এবং রিকভারীর সাথে পুঁজিবাজারের যে যোগসূত্র- সেই দুই জায়গাতেই বাধা আছে। সেখানে সুর্নির্ধারিত বা নিয়মিত নীতিমালা নাই। এছাড়া মুভমেন্টটা ইক্রিমেন্টাল হতে হবে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা একেবারে বড় জাম্প করতে পারবো না। স্থানীয় বাস্তবতাকে মাথায় রেখে আমাদের চলতে হবে। আইনগত সংস্কার, অডিট ও স্বচ্ছতা শক্তিশালীকরণও এটির সঙ্গে জড়িত। একইসাথে মালিকানার সাথে বেসরকারিকরণ অবশ্যই জরুরি বলে মনে করছেন দেশের অর্থনৈতিক খাতের বিশিষ্টজনেরা।
সোমবার (৩ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জ আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা: পুঁজি কেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের অর্থনীতিবিদ হাসনাত আলম। আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ।
আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা স্টক একচেঞ্জ ব্রোকারেজ এসোসিয়েশন (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, প্রাইম ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা হাসান উর রশিদ ও সিটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান, পুঁজিবাজার বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জানালিস্টস ফোরাম (সিএমএজেএফ)-এর প্রেসিডেন্ট এসএম গোলাম সামদানী ভূঁইয়া, সিএমএজেএফ’র সাবেক প্রেসিডেন্ট ও অর্থসূচক সম্পাদক জিয়াউর রহমান।
ঢাকা স্টক একচেঞ্জ ব্রোকারেজ এসোসিয়েশন (ডিবিএ)-এর প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় নাই। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এই দুইটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকলে অর্থনীতি আগানো কঠিন হবে। একইসাথে অর্থমন্ত্রণালয়, জাতীয় বোর্ড এবং বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে একসাথে নিয়ে কাজ করা উচিত।
তিনি বলেন, দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম দূর্বলতা কার্যকর বন্ড মার্কেট না থাকা। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্ড মার্কেট খুবই শক্তিশালী। সম্পদভিত্তিক বন্ড মার্কেট দরকার। বন্ডের নীতিমালা শক্তিশালী করে ট্রেজারি বন্ডকে পুঁজিবাজারে লেনদেনযোগ্য করতে হবে। এই বন্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছেও পরিচিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জনপ্রিয় করতে আগামী ১০ বছরের মুনাফার ওপর কর মওকুফ করতে হবে। ক্যাপিটাল গেইনের ওপর যেমন ছাড় ছিল, ঠিক তেমনি বন্ডের ওপর করছাড় দিতে হবে। একইসাথে মার্জারসংক্রান্ত আইনেরও কিছুটা সংশোধনী আনতে হবে। নইলে অর্থনীতিতে আস্থা ফেরানো কঠিন হবে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিগত সময়ে নন পারফর্মিং লোন (এনপিএল) ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। বর্তমানে আস্থা ফেরাতে মূলধন জরুরি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
সিটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকের ঋণকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদন্ডে বিচার করতে হবে। ঋণগুলোতে তিনভাগে ভাগ করে পৃথকপৃথক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশকে অবশ্যই অর্থনীতির বৈশ্বিক সূচকগুলো মানতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশের ন্যারেটিভ তৈরি করা সম্ভব নয়।
হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং পার্টনার এএফ নেছারউদ্দিন বলেন, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের ব্যাংকের বেশি ছাড় দেওয়ার কারণেই মন্দ ঋণ বেড়েছে। মন্দ ঋণের ব্যাংকগুলোকে আস্থা ফেরাতে অবশ্যাই খেলাপী পরিচালকদের বের করে দিয়ে আমানতকারীদের হাতে ব্যাংকের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে।
পুঁজিবাজার বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জানালিস্ট ফোরামের (সিএমএজেএফ) প্রেসিডেন্ট এসএম গোলাম সামদানী ভূঁইয়া বলেছেন, ২০০৯-১০ সালে ব্যাংকগুলোর সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আগ্রাসী বিনিয়োগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর দলীয় গবর্নরের কারণে ব্যাংকগুলো ব্যাপক অনিয়ম করেছে। কোন কোন ব্যাংক এক্সপোজারের বাইরে গিয়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে। ফলে ২০১০ সালে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়। এককালে বিমার টাকা উঠানোর জন্য তদ্বির করতে হতো এবং সাংবাদিকদের কাছে ব্যাংকের টাকার তুলে দেওয়ার ফোন আসে। আস্থাহীনতার চরম সংকটের কারণে এমনটি হচ্ছে।
অর্থসূচক সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। আর্থিক খাতের উন্নয়নে সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি। এছাড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুশাসন ফিরিয়ে আনা জরুরি।