চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে প্রায় ১৬ মাস ধরে নিখোঁজ ৭০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির সন্ধানে নেমে চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, দুই শিশু সন্তান রেখে ওই ব্যক্তির প্রথম স্ত্রী মারা যায়। দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সেই সংসারে দুই সন্তানের ঠাঁই হয়নি। নিতান্ত অবহেলায় চাচা-ফুপুদের কাছে বড় হওয়ার পর বাবার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জেদ চাপে তাদের। এ প্রেক্ষিতে বাবাকে খুনের জন্য নিখুঁত পরিকল্পনার জাল বোনে।
এরপর একদিন বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন নিজেদের জন্মদাতা বাবাকে। খুনের পর লাশ গুম করে ফেলে তারা। ঘটনার পর ১৬ মাস পর এক ছেলেকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ঘটনার রহস্য উদঘাটন করলেও সেই ব্যক্তির লাশ কিংবা গুম করার স্থানের হদিস এখনও পায়নি পিবিআই।
মৃত মীর মজিবুর রহমান খানের (৭০) বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নের পূর্ব চাম্বল গ্রামে। সম্পদশালী মজিবুর দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানদের নিয়ে নগরীর ঘাটফরহাদবেগ এলাকায় নিজ বাড়িতে থাকতেন। আর মৃত প্রথম স্ত্রীর দুই সন্তান গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
গত মাসে (অক্টোবর) আদালতের নির্দেশে নগরীর কোতোয়ালি থানায় মজিবুর নিখোঁজের বিষয়ে মামলা করেন তার দ্বিতীয় সংসারের মেয়ে সালমা খানম। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত শুরু করে পিবিআই। ওই মামলায় গত শনিবার (১ নভেম্বর) মজিবুরের ছেলে মো. আনোয়ারকে (৪০) চাম্বল থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই টিম। রোববার রাতে আনোয়ার তার বাবাকে খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. নাজমুল আলম সারাবাংলাকে জানান, ২০২৪ সালের ৭ জুন সকাল ৯টার দিকে নগরীর ঘাটফরহাদবেগের বাসা থেকে মজিবুরকে মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় মেয়ে সালমা খানম প্রথমে কোতোয়ালি থানায় নিখোঁজ সংক্রান্তে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরে তিনি অপহরণের অভিযোগে তার দুই সৎ ভাই, চাচা ও ফুপুদের নামে আদালতে মামলা করেন। আদালত ওই মামলা তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
কিন্তু একবছর পার হয়ে গেলেও নিখোঁজ মজিবুরের কোনো সন্ধান না পেয়ে মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনায় সেটিকে সরাসরি থানায় এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করার জন্য পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত গত অক্টোবরে আবেদন গ্রহণ করে আবার পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর আনোয়ারের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার জবানবন্দিতে উঠে আসে ঘটনার বিস্তারিত।
এসআই নাজমুলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, আনোয়ারের মা যখন মারা যান, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। তার ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল ৬ বছর। তাদের মা মারা যাওয়ার পরপরই মজিবুর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেই সংসারে প্রথমে কিছুদিন তাদের ঠাঁই হলেও সবসময় মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এরপর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে চাচা-ফুপুদের কাছে। মজিবুর কখনো তাদের খোঁজ নিতেন না। ভরণপোষণও দিতেন না। এক পর্যায়ে মজিবুর তাদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ করে দেন।
‘পরবর্তীতে দুই ভাই জানতে পারেন যে, তাদের পৈতৃক সম্পদ থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের বাবা গ্রামের ও শহরের সব সম্পদ দ্বিতীয় সংসারের সন্তানদের নামে লিখে দিচ্ছেন। সেটা জানার পর তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। আনোয়ারের বয়স এখন ৪০। তার ভাইয়ের বয়স প্রায় ৩৫ বছর। তাদের প্রতি বাবার অবহেলা এবং সর্বশেষ সম্পদ থেকেও বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় তারা প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে। দুই ভাই মিলে বাবাকে তাদের কাছে এনে জিম্মি করে সম্পত্তি লিখে নেওয়ার ছক আঁটে।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এসআই নাজমুল বলেন, ‘এক নারীকে দিয়ে মজিবুরকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে দুই ভাই। ওই নারীর মাধ্যমে মজিবুর তাদের পাতা ফাঁদে পা দেন। ২০২৪ সালের ৭ জুন সকালে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে ওই নারীর সঙ্গে মাইক্রোবাসে ওঠে চলে যান। এরপর তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আনোয়ার ও তার ভাই মিলে মজিবুরকে বাঁশখালীর চাম্বলে তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তার কাছ থেকে সম্পদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে ওই রাতেই তাকে ভাতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে প্রায় অজ্ঞান করে গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে। এরপর লাশ গুম করে ফেলা হয়।’
লাশ কোথায়, কীভাবে গুম করা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আনোয়ার দেননি বলে জানান পিবিআইয়ের এ কর্মকর্তা।