ঢাকা: আসছে ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেজন্য গত ৩ নভেম্বর ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। আর ৬৩টি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৪০টি শরিকদের জন্য এবং বাকি ২৩ আসনের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানাবে দলটি। এদিকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর দেশব্যাপী নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কোথাও আনন্দ, আবার কোথাও বিষাদ। কারও কারও আবার বিষাদ থেকে ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সড়ক ও রেলপথ অবরোধের মধ্য দিয়ে দেখা গেছে।
বিভিন্ন সুত্র থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ২৩৭ জনের নাম ঘোষণার এক দিন পরেই অনিবার্য কারণ দেখিয়ে মাদারীপুর–১ আসনের প্রার্থী কামাল জামান মোল্লার মনোনয়ন স্থগিত করেছে দলটি। মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বিকেলে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।
জানা গেছে, সোমবার সন্ধ্যায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পরপরই মাদারীপুর–১ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থী জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা ঢাকা–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনার একদিন পরেই ওই আসনে ঘোষিত প্রার্থীর মনোনয়ন স্থগিত করল দলটি।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির মনোনয়ন না পাওয়াকে কেন্দ্র করে মহাসড়ক অবরোধ ও সহিসংতার ঘটনায় দলটির নেতা আসলাম চৌধুরীর ৪ অনুসারীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৪নভেম্বর) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বহিষ্কৃতরা হলেন- স্বেচ্ছাসেবক দলের সীতাকুণ্ড উপজেলা সভাপতি আলাউদ্দিন মনি, সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন বাবর, সীতাকুণ্ড পৌর আহ্বায়ক মামুন এবং সোনাইছড়ি ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মমিন উদ্দিন মিন্টু।
মেহেরপুর-২ আসনের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে জেলার গাংনী উপজেলা বিএনপির দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দুপুরে মনোনয়নপ্রাপ্ত সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন এবং জেলা বিএনপির সভাপতি জাভেদ মাসুদ মিল্টনের সমর্থকদের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন।
সাতক্ষীরা-২ আসনে বহিষ্কৃত নেতা আব্দুর রউফকে বিএনপি মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদে ও ত্যাগী নেতা আব্দুল আলিমকে মনোনয়নের দাবিতে সাতক্ষীরায় মশাল মিছিল করেছে বিএনপির একাংশ। সোমবার (৩ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিম সমর্থকরা সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের তালতলা এলাকায় সড়কে আগুন জালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি-কালিগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়ন না পাওয়ায় ‘গরিবের ডাক্তার’ নামে পরিচিত মো. শহিদুল আলমের সমর্থকেরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কালিগঞ্জ প্রধান মহাসড়কে স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে।
ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এম ইকবাল হোসেইনকে পরিবর্তনের দাবিতে গৌরীপুরে ট্রেন আটকে রেলপথ অবরোধ ও শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন মনোনয়নবঞ্চিত আহাম্মদ তায়েবুর রহমানের অনুসারীরা। মঙ্গলবার সকালে গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনে এবং দুপুরে শহরে তারা বিক্ষোভ করেন।
চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এম এ হান্নানের ক্ষুব্ধ সমর্থকরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সোমবার (৩ অক্টোবর) রাতে ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করেন তারা। পরে বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা। মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে থানার মোড়ে সমাবেশে মিলিত হয়।
৪ নভেম্বর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলা সদরের বাসস্ট্যান্ড ফরিদগঞ্জ-রায়পুর সড়ক হান্নান সমর্থকেরা অবরোধ করে রাখেন। পরে থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করে। সকাল থেকেই ফরিদগঞ্জ পৌর বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হন। সেখানে তারা টায়ারে আগুন দিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় তারা বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়া লায়ন মো. হারুনুর রশিদের বিলবোর্ড ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেন। অবরোধ ও ভাঙচুরের ফলে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
কুমিল্লা-৬ (সদর, সদর দক্ষিণ ও সিটি কর্পোরেশন) আসনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্দোলনে নেমেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের সমর্থকরা। সোমবার রাতে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, পাড়া-মহল্লা থেকে হাজারো নেতাকর্মী কান্দিরপাড়স্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন। রাত ১০টার দিকে কান্দিরপাড়ে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধের মাধ্যমে বিক্ষোভ শুরু হয়। এ সময় বেশ কিছু বিকট শব্দ শোনা যায়। পরে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে আলেখারচর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করলে দুই পাশেই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে বিএনপির স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য সোহরাব উদ্দিন দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন তার অনুসারী নেতা-কর্মীরা। সোমবার (৩ নভেম্বর) রাত ৯টার দিকে শহরের মজমপুর রেলগেটে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে এ বিক্ষোভ করেন তারা। সেখানে বিক্ষোভকারীরা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভের পাশাপাশি প্রতিবাদ মিছিলও করেন। এ ছাড়া সদর উপজেলার মধুপুর-লক্ষীপুর এলাকাতেও সোহরাব উদ্দিনের সমর্থকেরা সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন।
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের সহ-শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক ও দুইবারের (২০০১ ও ২০০৮) সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম আশরাফ উদ্দিন নিজান বলেছেন, ‘আমরা ইলেকশনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। উই আর ডিসাইডেড, আওয়ার পিপলস ডিসাইডেড, নেতাকর্মীরা ডিসাইডেড, যখন দেয় নাই নেতাকর্মীরা তো অসম্ভব বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। আমরা ভোট করব, ডিসাইডেড। পার্টি আমাদের দেয় নাই, হয়তো টেকনিক্যাল সমস্যায় আছে। সেজন্য ডিলে করতেছে।’
টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার দাবিতে মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিনব্যাপী দুটি পৃথক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও মনোনয়ন প্রত্যাশী অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবালের সমর্থকরা, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির প্রচার সম্পাদক ও মনোনয়ন প্রত্যাশী সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সমর্থকরা মনোনয়ন পাওয়ার দাবিতে মিছিল করেন। দলীয় সূত্রে জানা যায়, সোমবার কেন্দ্রীয় বিএনপি টাঙ্গাইল জেলার আটটি আসনের মধ্যে সাতটি আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তবে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের প্রার্থীর নাম এখনো ঘোষণা করা হয়নি। এতে আসনটিতে দুই শীর্ষ নেতার সমর্থকরা মাঠে নেমেছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘যারা মনোনয়ন পাননি, বিশ্বাস রাখুন, দল তাদের যথাযথ দায়িত্ব ও সম্মান দেবে।’ ৪ নভেম্বর দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে এমনটি বলেন তিনি। পোস্টে বিএনপি মহাসচিব লিখেন, বিএনপি আমাকে ঠাকুরগাঁও ১ আসনে মনোনীত করেছে। আমি বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, এবং সব নেতা-নেত্রীকে আমার কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। দলের সব কর্মীকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ, আজীবন আমার সঙ্গে থাকার জন্য।’
মির্জা ফখরুল লিখেন, ‘আমরা যারা সারাজীবন রাজনীতি করেছি, জেলে গিয়েছি, আমাদের নিজেদের একটা গল্প থাকে…গল্পগুলো অন্য কোনো দিন বলব যদি আল্লাহ চান। এরকম গল্প আমাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর আছে।’ তিনি লেখেন, ‘এই নির্বাচন হয়তো আমার শেষ নির্বাচন। যারা মনোনয়ন পাননি, বিশ্বাস রাখুন, ইনশাআল্লাহ দল আপনাদের যথাযথ দায়িত্ব ও সম্মান দেবে। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন, আমাদের দলের প্রত্যেক নেতা-কর্মীর জন্য দোয়া করবেন।’ ‘আমরা সবাই মিলে আপনাদের পাশে থাকব এবং কাজ করব, ইনশাআল্লাহ। বিএনপির সেই যোগ্যতা আছে দেশকে মর্যাদার সঙ্গে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ইনশাআল্লাহ! আপনারা পাশে থাকবেন।’
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল অব. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর এ নিয়ে বিক্ষোভ হলেও কোথাও মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি।’